Skip to main content

স্বভূমিতে আদি পরবাসী ||-কৃষ্ণেন্দু সাঁতরা





ছেলেবেলায়, দোলের আগের দিন, যখন প্রথম শুনেছিলাম-"আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া/কাল আমাদের দোল!তখন শঙ্কিত হয়ে শিউরে উঠেছিলাম এই ভেবে,এত্তো কঠিন কঠিন আইনের শাসন উপেক্ষা করে সবাই ন্যাড়াকে পোড়াবে অথচ ন্যাড়ার বাড়ির লোক কোন কেস-কাঁচারী করবে না? !!কী উদাসীন ফ্যামিলি রে বাব্বা!  আহারে ন্যাড়া!আহা ন্যাড়া!

আসল ঘটনা ,এট্টু বড় হয়ে তবে জানলাম; দোলের আগের দিন খড়, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে এক বিশেষ বহ্ন্যুৎসব  হয়। এই বহ্ন্যুৎসবই হোলিকাদহন বা নেড়াপোড়া/ ন্যাড়াপোড়া।তবে যাই বলেন,ন্যাড়ারা যুগে যুগে নানারূপে পুড়েছে।ন্যাড়া মোটামুটিভাবে জেনেও গেছে যে তাকে পুড়তে হবে। তাই এই বসন্তের হোলিকাদহনের ন্যাড়াকে জতুগৃহে না ঢুকিয়ে বা গল্পের ন্যাড়াকে গাছে না চড়িয়ে,সোজা এরোপ্লেন করে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়া হল পাহাড়ি জঙ্গলগুলোয় !  সেখানে সে দেখল- ইন্টারনেট নেই, টিভির খবর নেই, পোষ্ট আফিসের চিঠি নেই ! অথাৎ কোন খবর বা সরকারি আদেশনামা সেখানে পৌঁছাতে পারে না। পৌঁছালেও ,স্বাভাবিক ভাবেই  সেই অমূল্য কাগজের মর্মবাণী মুর্মু -সোরেন -হেমব্রম ভাইরা উদ্ধার করতে পারেন নি।(কাঠ মধু আর পেটের আগুনের পাঠ উদ্ধার করতে করতেই  সময় চলে গেছে তাদের)। জল-জঙ্গল-পাহাড়ের আদি বাসিন্দাগণের সিংহভাগ জানতেই পারেননি,একটি সরকারি আইন প্রণয়ন হয়ে গেছে!জল-জঙ্গল-পাহাড় আর তাদের নেই! হ্যাঁ, সরকার তাদের সুযোগ দিয়েছিল ।মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের সুযোগ দিয়েছিলেন।একটা আবেদন করার সুযোগ; যাতে জঙ্গলের অধিকার কেড়ে নেওয়ার আগেই পুনর্বাসন করা যায় ।
ঘটনার সুত্রপাত অনেক অনেক বৎসর আগে।তখন ইংরাজ রাজ চলছে ।১৮৭৮ সালে এক কলমের খোঁচায় দেশের একচতুর্থাংশ অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত সমগ্র অরণ্যভূমিকে রাষ্ট্রের সম্পত্তি বলে ঘোষণা করে আদিবাসীদের পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।এতদিন ধরে বসবাস করে আসা জমিতে তাঁরা আইনের চোখে হয়ে যায় জবরদখলকারী বা এনক্রোচার। আইনের ( ফরেস্ট অ্যাক্টের )সাথেই আসে জমি অধিগ্রহণ আইন- ১৮৯৪। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী-  জওহরলাল নেহরু,আদিবাসী পঞ্চশীলে আদিবাসীদের জমি ও অরণ্যের অধিকারকে স্বীকার করার এবং সম্মান করার কথা থাকলেও, সে কথা ছিল নিতান্তই কথার কথা। বনাঞ্চলের ভূমিপুত্রদের স্বাভাবিক অধিকারকে খাতায় কলমে মেনে নিতে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রনায়কদের লেগেছিল আরও অর্ধ শতাব্দী। ২০০৬ সালে, অরণ্যের অধিকার আইন পাস হয়। তার পোশাকি নাম, "বনবাসী তফশিলি জনজাতি এবং অন্য পারম্পরিক বনবাসীদের অরণ্যের অধিকার স্বীকার আইন, ২০০৬"। আইনের প্রস্তাবনায় বলা হচ্ছে, "বনবাসী তফশিলি জনজাতি এবং অন্যান্য যে সমস্ত পারম্পরিক বনবাসীরা বংশানুক্রমে অরণ্যে বাস করছেন, তাঁদের বন-সম্পদের ও বনভূমির উপর দখলিস্বত্বের অধিকার এতকাল নথিবদ্ধ করা যায়নি। তাদের এই অধিকার স্বীকার ও প্রদানের জন্য, বিভিন্ন স্বীকৃত ও অর্জিত অধিকারগুলিকে নথিবদ্ধকরণের এক প্রক্রিয়া শুরু করার জন্যই- "অরণ্যের অধিকার আইন ২০০৬"।
তবু চলে যাচ্ছিল।স্বভূমিতে ভারতবর্ষের আদি-বাসিন্দা,আদিবাসী সম্প্রদায়ের চলে যাচ্ছিল কোনমতে । কিন্তু রাষ্ট্রীয় নেতাগণ বিভিন্ন বিল পাস করাচ্ছেন আর ভাবছেন- "এতো বড় জল-জঙ্গল-পাহাড় পড়ে থাকে কেন!!" অবশেষে নতুন  আইন পাশের জন্য তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলেন।পক্রিয়া টা চলছিল   ২০০৬ সালের পর থেকেই।কিছু দিন হল- সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিয়েছেন। ষোলোটা রাজ্যের দশ লাখের ওপর বনাঞ্চলবাসী/আদিবাসীকে উচ্ছেদ করার নির্দেশনামা( আগামী ২৭ জুলায়ের মধ্যে)। উচ্ছেদ করার আগে ,অরণ্যের অধিকার আইন  ২০০৬ অনুযায়ী  আবেদন করা ও পাট্টা পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল অন্যথায়  তাঁদের বন থেকে সরে যেতে হবে।(তবে?ওই তো- রাষ্ট্র সুযোগ দিয়েছিল !)সমস্যা হল- এই আবেদন করার সুযোগ বা খবর পৌঁছলো না।কোন নেতা মন্ত্রী, কেউ খবর পৌঁছে দিলনা!সমগ্র ভারতবর্ষের আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে একটা পাল্টে যাওয়া আইনের খবর পৌঁছালো না !! তাঁরা আবেদন করতে পারতেন- পুনর্বাসনের, আবেদন করতে পারতেন "ভূক্তভোগী পাহাড়ি বাসিন্দা" হিসাবে ।আইনে আবেদনকারীর পুনর্বাসনের দিকটি নির্দিষ্ট করা ছিল ।
  কিন্তু বিপুল সংখ্যক আদিবাসীর কাছেই খবর পৌঁছালো না । অবাক করা ঘটনাটা হল- আদিবাসী মহিলারা উচ্ছেদ হয়ে যাবেন সবচে বেশি সংখ্যায়। কারণ, আদিবাসীদের মধ্যে "একক-মহিলা-কর্ত্রী" পরিবার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী এবং আটটি রাজ্যে চালানো একটি সার্ভে বলছে এরকম পরিবারগুলির ৬৮%ই আবেদন করেনি মূলত জানকারির অভাবে বা খবরটা না পাওয়ার জন্য ।
আমাদের এই বসন্ত উৎসব আর ভোটউৎসব থেকে দূরে দাঁড়িয়ে একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই আর রোজগার করে পেটের জ্বালা কোন রকমে মিটিয়ে বেঁচে থাকতে ,যদি তাঁরা সিধু-কানহু হয়ে ওঠেন তখন রাষ্ট্র কী ''নামে'' তাঁদের ভূষিত করবে তা তো-আপনি আমি জানি!! শেষ যেটুকু খবর -আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন একটি অরাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন করছেন বলেই শুনেছি, যেটি সুপ্রিম কোর্টের কাছে রায় পুনঃবিবেচনার জন্য এবং "স্টে-অর্ডার" সংক্রান্ত । হে স্বদেশ, আমার ভারতবর্ষ; তাঁরা যেন তাঁদের ''উদ্বাস্তু হওয়া" থেকে রক্ষা পান। সিঁধু-কানুর অগ্নি ঘোড়া -শান্ত হোক শাল-পিয়ালের ছায়ায় ।তাঁদের একটুখানি ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলে উঠুক ।
উদ্বাস্তু হলে কী হবে? কাদের উদ্বাস্তু কে করবে! ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা তাঁরা।তাঁরা কোন স্মরনার্থী নন,অনুপ্রবেশের প্রশ্নই ওঠে না ;কারণ - অনার্য সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা,আর্য পরে আসে ।সুতরাং .......।
যাক্! অরিজিন্যালি-যাঁরা পারেন -এই দহন বন্ধ করতে, এই দূর্বল মানুষ গুলোকে রক্ষা করতে- বেঘর হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে তাঁরা -রাষ্ট্র নায়কগণ বা দেশের নীতি নির্ধারক  নেতাগণ;  কিন্তু এই সব তুচ্ছ ব্যাপারে তাঁরা তাঁদের "মস্তক ঘর্মাক্ত" করতে ভূলে গেছেন !! তাঁদের রিমাইন্ড করে দিতে-  হোয়াটস্ অ্যাপে পিং করতে যে নং দরকার, তা আমাদের কাছে নেই !কারণ- ওনারা বিবৃতি দেন ;বিবৃতি নেন না ।
ছোট্ট বেলার মিথ্যে ভয়টাই বোধহয় সত্যি হবে; ন্যাড়াদিগকে  বোধহয় সত্যিই পুড়িতে হইবে ,আমরা তাহাকে হোলিকাদহনের প্রলেপে ঢাকিব মাত্র .......।

Popular posts from this blog

কাব্যগ্রন্থ ।একতারার সুর । পলাশ পোড়েল ।বই

  কাব্যগ্রন্থ : একতারার সুর । পলাশ  পোড়েল AKTARAR SUR by PALASH POREL book published on- 2020 ।  একটি বংeZIN প্রয়াস: ‘ই-বই’ প্রকাশকাল-ইং ২০২০ সাল।   ই-বই PDF file ডাউনলোড করার জন্য বংeZIN e-BOOK ছবি লিঙ্কে ক্লিক করুন  ➧     কৃষ্ণপ্রেমের অলীক সুতোয় যে সুর বেজে ওঠে কবি মনে তা যখন কাব্য রূপ নেয়- সেই মধুর মূর্ছনা, আছন্ন করে পাঠককে ।কবি পলাশ  পোড়েলের কবিতা শুধু আছন্নই করে না, বরং কৃষ্ণপ্রেমের সুর বোষ্টমির হাতের একতারা হয়ে- এক নৈস্বর্গীক প্রেম চেতনার অনুরননে পাঠক হৃদয়কে তৃপ্ত করে । অনুভুতির কবিতা- সুরে জেগে থাকার কবিতা –‘একতারার সুর’ কাব্যগ্রন্থ।প্রকাশ আঙ্গিকের ছন্দে- কবির  ভালোলাগা সকলের হয়ে ওঠে। কবিতা লেখার জগতে নব্য এক মননের চেষ্টা-একতারার সুর কাব্যগ্রন্থ- টি ।বংeZIN প্রকাশনী তাকে সম্মান করে । কবিতাগুলি যদি পাঠকের ভালো লাগে তবে-এই প্রচেষ্টা সফল । -        প্রকাশক  [বংeZIN প্রকাশনী]  

বই ।। গৌরদাসের আখড়ার বোষ্টমি ।।পলাশ পোড়েল

কাব্যগ্রন্থ ।।  গৌরদাসের আখড়ার বোষ্টমি।।   পলাশ পোড়েল   ই-বই PDF file ডাউনলোড করার জন্য বংeZIN e-BOOK ছবি লিঙ্কে ক্লিক করুন  ➧   কাব্যগ্রন্থ : গৌরদাসের আখড়ার বোষ্টমি । পলাশ  পোড়েল বোষ্টমির প্রেম –সাধনা- আগুন রূপের-  নিত্য পুড়ে যাওয়া –কাব্য রূপে কবিতার ছন্দে ফুটে ওঠে - কাব্যগ্রন্থ : গৌরদাসের আখড়ার বোষ্টমি –তে। কৃষ্ণপ্রেমের সুর বোষ্টমির হাতের একতারা হয়ে- এক নৈস্বর্গীক প্রেম চেতনার অনুরননে পাঠক হৃদয়কে তৃপ্ত করে । অনন্য অনুভুতির কবিতা- সুরে জেগে থাকার কবিতা –সাধনাকে জীবন করে বেঁচে থাকার গল্প বলে- গৌরদাসের আখড়ার বোষ্টমি   কাব্যগ্রন্থ। কবির প্রকাশ আঙ্গিকের ছন্দে-   ভালোলাগা আর ভালোবাসা - সকলের মনে অনুরণন তোলে।

বৃষ্টি সন্ধানী ।।অমিতাভ সেনগুপ্ত ।।ধারাবাহিক অনুবাদ-১

বৃষ্টি সন্ধানী ।।অমিতাভ সেনগুপ্ত ।।ধারাবাহিক অনুবাদ-১ (Chasing the Monsoon-Alexander Frater থেকে অনুবাদ) (কপিরাইট- অমিতাভ সেনগুপ্ত ।। বাণিজ্যিক কারণে ব্যবহৃত নয়।)  (১) প্রথম যে শব্দ শুনি তা ছিল বৃষ্টি পড়ার। মনে হয় একধরনের ধাতব ভার ও ভর থাকে উষ্মমন্ডলীয় বর্ষার। সেটাই অঝোর ঝরছিল যখন আমার মায়ের প্রসব ব্যাথা শুরু হয় দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপের ছোটো মিশন হাসপাতালে। বৃষ্টি ঝরেই চলেছিল তাঁর প্রসব কালে। আমি ভূমিষ্ঠ হবার কিছু পরেও শোঁ শোঁ আওয়াজে বাইরের ঘন পত্রগুচ্ছের আড়াল ঠেলে ঝালাই করা লোহার ছাদে বাজনা বাজাচ্ছিল বৃষ্টি। মাকে প্রসব করাচ্ছিলেন আমার বাবা। যে কোনো দিকেই বহু হাজার মাইলের মধ্যে উনিই তখন একমাত্র চিকিৎসক। সপ্তাহে বহুবার জরুরি কলে যেতেন মোটর বোটে । অধিকাংশ সময় প্রত্যন্ত গ্রাম, জনবসতিতে রোগীর কাছে পৌঁছতে পাড়ি দিতেন দূর দূরান্ত। সুতরাং তাঁর কাছে নিছক কৌতুহলের বিষয় ছিল না আবহাওয়া । ক্রমাঙ্ক করা কাচের বৃষ্টি মাপার যন্ত্র, হাসপাতালের বাগানে রাখা লড়ঝড়ে বায়ুমানযন্ত্র দিয়ে বৃষ্টি মাপতেন এবং নোটবন্দী করতেন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, রোদের ঘন্টা মিনিট, বাতাসের গতি ও নিশানা...