গল্প: বেওয়ারিশ-কৃৃষ্ণেন্দু সাঁতরা
তার ঈশ্বরের মতো মায়াবী চোখ দু'টো এখনো খোলা আছে। ভাগ্যক্রমে চোখে কালশিটে দাগ নেই ! রক্ত মাথা থেকে
গড়িয়ে পড়েছে মাটিতে। ঠোঁটের কোণায় হেয় করা হাসি লেগে আছে এখনও ! এখন এটাকে একটা
মৃতদেহ বলা যেতেই পারে যেটা পড়ে আছে পিচরাস্তায়;যেমন পিচ রাস্তায় কুকুর বা শিয়ালরা
পড়ে থাকে,নাইট সার্ভিসের বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কা খেয়ে-চোখ উল্টে মরে! ভিড়ের জনতা খুব
খুঁটিয়ে দেহটা লক্ষ্য করছে। দেহটা অপরিচিতা নয়। (যদিও মৃতদেহের বা লাশের জেন্ডার
না হওয়াই উচিত!) কিন্তু আদত ঠিকানা কারো জানা নেই।দেহটা হয়তো বেশিক্ষণ দেখা সম্ভব
হবে না! পুলিশ এসে পড়লেই ভিড়টা হটিয়ে দেওয়া হবে ! ভিড় হটিয়ে দেওয়াটা জরুরি! না!
না! বডি তুলতে কেউ বাধা দেবে না! নন-পলিটিকাল লাশ! একটা পাগলির বেওয়ারিশ লাশ! এসব
লাশের ওয়ারিশন হয় না! ভিড় থেকে একটা লালচোখ মাতাল, প্রশ্ন করল--" এটা কি খুন?
গলায় কেমন যেন দাগ দাগ!..."
ভিড়টা তার দিকে ফিরে তাকাল এবং মাতালের হাঁ করা মুখের গভীরে গলা ভর্তি মদ
দেখতে পেল এবং নিশ্চিন্ত হল!ধুস্! পাগলিকে কে বা খুন করবে?পোষানোর একটা
ব্যাপার আছে তো! হাজার হোক পাগলি তো!!-তো?ভিড়টা আবার গভীর মনোযোগ দিয়ে
পাগলীর মৃতদেহটা দেখতে লাগলো। পায়ের কাছেও রক্তদাগ! ভিড়টা আলোচনা করতে লাগলো, বিভিন্ন
অ্যাঙ্গেল থেকে বিভিন্ন সম্ভাবনার কথা তারা আলোচনা করল.......
সর্বপ্রথম,তারা গাড়িতে ধাক্কা খাওয়ার তত্ত্বটি খাড়া করল।
রাতের বেলার 'নিয়ম না মানা ড্রাইভিং' নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা তাদের মধ্যে চলতে
লাগলো।-" রাত্রিবেলার গাড়ি গুলো রাস্তার মানুষ কেন,কুকুর ছাগল শৃগাল ইত্যাদি
কিছুই দেখতে পায় না!"
একজন অকালপক্ক ভিড় থেকে ফুট কাটলো-"রাতের বেলা,কুকুর শৃগাল রাস্তায়
চড়তেই পারে-তা বলে ছাগলের রাস্তায় ঘোরাঘুরিটা উচিত নয়,বরং গোয়ালে থাকাটাই উচিত!"
কয়েকজন, এই অকালপক্ক যুক্তিবাদীকে সমর্থন করল-"ঠিকই তো!লজিক তো তাই বলে!"অনেকে
বল্ল-"রাতের নিয়ম না মানা ড্রাইভাররা মত্ত অবস্থায় ড্রাইভিং করে!তাই তো এত্তো
দুর্ঘটনা ঘটে! " এ ব্যাপারে তারা আন্দোলন করবে বলে মনে মনে ভাবছিল....।
দ্বিতীয়তঃ তারা আত্মহত্যার তত্ত্বটা খাড়া করল এবং পাগলীর আত্মহত্যাকে
তারা বৈধ ধরে নিলো। একজন হতাশ পাগলী নিতান্তই
আত্মঘাতী হতেই পারে!এবং আত্মহত্যার পিছনে একাধিক কারণ অনুসন্ধান করতে থাকল।কারণ
গুলো অধিকাংশই রসাল ছিল ।
তৃতীয়তঃ কেউ কেউ কষ্টকল্পনায় ভিত্তি করে- বন্য পশুর আক্রমণের তত্ত্বও কষ্ট
খাড়া করতে চাইল।কিন্তু এই এলাকায় দীর্ঘ কয়েকযুগ কোন হিংস্র বাঘ সিংহ বা ডাইনোসর বা
অ্যানাকোন্ডার দেখা পাওয়া যায়নি!সুতরাং এই তত্ত্বটি খারিজ করা হল।
ভিড়টা এবার পাগলির স্মৃতি মন্থন করতে উৎসাহী হল......।একটা বিষয়ে সবাই
নিশ্চিত- পাগলিটা পাগলিই ছিল।জন্মাবধি পাগলী ছিলনা হয়ত ! তবে পাগলিটা, পরে কোন এক সময়ে
পাগলি হয়েছিল এবং কোনো তারিখটারিখ,তিথিনক্ষত্র মেনে, সাক্ষীসাবুদ রেখে ,সে পাগলি হয়নি!
পাগলিটা হঠাৎই আবিষ্কৃত হয়। যেমন করে হঠাৎ কোন সকালে সন্ধ্যায় বা রাত্রিতে বাজারের
রাস্তায় পাগল পাগলিদের আবিষ্কার করা হয়। পাগলদের কিবা দিন,তার আবার রাত্রি। রাত্রিতে
অনেক অনেক ঘটনা ঘটে; সেসব ঘটনাগুলো দিনের আলোর মত স্বচ্ছ তবু কেউ দেখতে পায়না অথবা
চায়না। কে আর হৃদয় খুঁড়ে ঝামেলা জাগাতে চায়!
পাগলিটার শীত পেতো। যেমন মানুষের পায় সাধারণত। খুব শীতে সে অনেক ছেঁড়া
কাপড় চাদর জড়িয়ে থাকতো আর একটা হাতা ছেঁড়া জামা......।শিশির ভেজা স্যাঁতসেঁতে সূর্যটা
নিয়মমাফিক যদি জ্বলে না উঠত, তবে বোধহয় সে মমি হয়ে যেত বা আগেই মারা যেত। আধা-পরিষ্কার
বাংলায় সে কথা বলত। কোনোমতে সারাদিনে শ'খানেক জিজ্ঞাসা বা আবেদন সে করে--"খেতে দিবি?"
না!কোনো ভিক্ষা নয়,আবেদন মাত্র।
পয়সা নেয় না, শুধু কেউ কিছু কিনে দিলে খায় অথবা পাগলির উপবাস শাস্ত্রসম্মত !তার
ভাষা সবাই বোঝে না ।তার বাদামি চুল আর সুশ্রী কটা মুখশ্রী দিয়ে, তাকে খ্যাপা প্রমাণ
করাটা মোটেও সহজ নয়! বরং তার বেশভূষার ছেঁড়া কাপড় আর একটা হাতা সম্পূর্ণ অদৃশ্য
হওয়া জামাটা দিয়ে তবু
তাকে পাগল বলা চলে।এই পাগলিকে নিয়ে অনেক অনেক কথা চালু ছিল ।কেউ কেউ সিআইডির
লোক বলেও ভাবতো; গভীর রাতে নাকি একটা গাড়ি আসে তাকে খাবার দিতে! রাতকানা হারুদা নাকি
স্বচক্ষে দেখেছে!! আবার 'ছেলেধরা'(উভয় অর্থেই) বলেও ফিসফিসানি চলে! লোকজন তাকে
"লোকাল" বলে। টাইটেল ধরলে দাঁড়ায়- "লোকাল খ্যাপা /খেপি" ।তার-
নামে সে কখনো আপত্তি তোলেনি কিন্তু আপত্তি সে করেছিল যখন.....
পরিত্যক্ত ইটভাটার আগুন দেয়ার খুপরিতে, আর্চের নীচে শুতে গেল এবং কয়েকটা
ভূত তাকে আক্রমণ করলো !সব কটা ভূত পুরুষ ছিল! নারী পুরুষের পার্থক্য সে বোঝে, অল্প
হলেও বোঝে ।সে প্রচণ্ড আপত্তি বা বাধা দিয়েছিল তারপর তার গলাটা টিপে ধরা হয় এবং শেষ
পর্বে তাঁর মাথাটা থেঁতলে দেওয়া হয় এবং দেহটাকে চৌরাস্তায় টেনে এনে রাখা হয়। কেউ
দেখেনি!না!না!! সত্যি কেউ দেখেনি! (তবু এতসব জানা গেল কীভাবে? এইসব শুধুমাত্র,পাগলিটির
অশ্রুত জবানবন্দী যা সে মহাকালের কাছে দিয়ে ছিল।)
হ্যাঁ, সে সেই থেকে মৃতদেহ হিসেবে গণ্য হয়েছে । সব মৃতদেহের বোধহয় মৃত্যু
হয় না। যেমনটা হয়নি পাগলিটির।তার ঈশ্বরের মতো চোখ দুটি এখনো খোলা আছে.....।
ওরা তিনজন ছিল। একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র ; তার ছেলে-বেলার স্কুলে
শেখা এসব স্মৃতি মনে আছে ।তারপর, তাকে যখন বিক্রি করা হয়েছিল তখনো একটা লোক টাকা দিয়েছিল
,একজন টাকা নিয়েছিল ,আর একজন তাকে স্যাঁতসেঁতে ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা দিয়ে ছিল ।এই
দরজাটা ক্রমাগত দেওয়া হচ্ছিল- চারে চতুর্বেদ, পাঁচে পঞ্চবাণ ,ছয়ে ঋতু!ঋতুমতী হবার আগে
থেকেই এসব তার সাথে হয়ে
ছিল! তার মাথাটা তখন থেকেই গুলিয়ে যায়! তারপর দাম কমে গেলে- একদিন রাস্তায়
ছুঁড়ে দেওয়া হয়। কোন রাস্তা ? তার মনে নেই ।রাস্তা তো রাস্তাই, তার আবার নাম কি!! যেমন
দেহ তো দেহই, তার আবার.....!যাক্! ওই তো ভিড়ের মধ্যে সেই দুটো ভূত তাকে দেখছে ওরা
গলাটিপে ধরেছিল। তিন নম্বর ভূত টা আসেনি , যেটা ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দিয়েছিল!
একটা ভ্যান এসে থামলো-পুলিশ ভ্যান। ভিড় কিছুটা কমলো ।--কে প্রথম দেখেছেন?
কে দেখেছেন? না। কোনো উত্তর নেই। কেউ প্রথম
দেখেনি। সব্বাই শেষে দেখেছে বা শেষের পরে। শেষমেশ বডি তোলার আয়োজন
শুরু হল। স্ট্রেচার নামল, ডোম গ্লাভস পরল। জনতার চোখ স্থির.....।
কিন্তু প্রথাগত নিয়মকে, রক্তাক্ত পায়ের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে- মৃতদেহটার পা দু'টো নড়ে উঠল! মৃতদেহের মায়াবী ঈশ্বরের
মতো চোখ দুটি থেকে, ক্লান্তি বিষণ্ণতা সরে গিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে এলো রাগ! দেহটা নড়েচড়ে
নড়বড়ে পায়ে ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়ালো !তার জাগতিক পোশাক খুলে পড়ল এবং ভিড় বা উপস্থিত
সকলকে স্তব্ধ করে দিয়ে - নগ্ন দেহটি বা নগ্ন
মৃতদেহটি বা নগ্ন পাগলিটি, তার হাত দুটি পাখির ডানার মতো দ্রুত আন্দোলিত করে উড়ে গেল!!
পাগলি উড়ে গেল মহাশূন্যের পথে,যে শূন্য থেকে -আমাদের এই পৃথিবী কে বড্ড ছোট্ট দেখায়.....।