নিবন্ধ :কোশি কালাধুঙ্গি করবেট সাব৷৷ -অমিতাভ সেনগুপ্ত
নেপালের চাতরা গিরিসংকট থেকে নেমে
উত্তর বিহারের কাটিহার জেলায় গঙ্গায় মেশা কোশি ওরফে সপ্তকোশী আলাদা নদী ।করবেট জাতীয়
উদ্যানের পূবসীমা দিয়ে বয়ে যাওয়া কোশি উত্তরাখন্ডের নৈনিতাল জেলার মোহন থেকে বেরিয়ে রামনগরের সবুজ
উপত্যকার মাঝ দিয়ে উত্তরপ্রদেশে রামগঙ্গা নদীতে পড়েছে। এ কোশি স্থানীদের মুখে
মুখে কোশিলা। কৌশল্যা নামের অপভ্রংশ কোশিলা। বিনা অস্ত্রে ভারত আত্মা রামময় করে গেছেন
ভক্ত তুলসীদাস ।
কোশিলা অন্য পাহাড়ি নদীর মতোই অগভীর । বর্ষায় দুর্বার। শিলাখন্ড,গাছের গুঁড়ির
ঘায়ে বিক্ষত বুক। পাহাড় ভাঙা খুনি মেজাজের
অগুন্তি ছাপ। অত্যাচারী ঈর্ষাকাতর প্রেমিক যেন।
জেন্ডার ডিস্ক্রিমিনেশন থাক। প্রেম যে করে সেই প্রেমিক। বিকেল হতে সস্তা, আরামদায়ক
হোটেলের ধাপ-সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলো দু’দন্ড বসি কোশির নিহত চড়ায়। ক্যামেরা থাক হোটেলের
ঘরে। কেউ নেবে না। আলো যত পড়ে আসে বোল্ডারগুলো এক একখানা বুনো জানোয়ারের আদল পেয়ে নড়েচড়ে ওঠে। শাপমুক্ত অহল্যা
একে একে জাগছে। হাতি,ভালুক,হায়না, নীলগাই,সম্বর।
খুঁজলে পাবে শার্দুল।
মঞ্চ আলো করা পপ গায়িকা স্নিগ্ধ
বৈশাখী চাঁদ কোশির পশ্চিম পাড়ে ফ্লেম অফ ফরেস্ট
সারির মঞ্চে উঠে এলে বাড়তেই থাকে চাওয়ার লোভ। যতই ভাবো না কিছু নেই। শিরায় শোণিতে চাওয়ার
কি শেষ হয় এ জীবনে। দু পাড়ের ঘন জঙ্গল থেকে
জল খেতে নেমে আসে হরিণ সম্বরের দল। কমলা ঠোঁট
লম্বা ল্যাজ নীল ম্যাগপাই ঝাঁক তিরের মতো উড়ে যায় বুনো ডুমুরের নিবন্ত জঙ্গলে। শিলাখন্ডের
ফাঁকে ফাঁকে সরু স্রোতে অপূর্ণ চাঁদের বিড়ম্বিত ছায়া কাঁপে। কোথাও বেড় বেশি স্রোতের । জল হাঁটু ছুঁই ছুঁই। দিনের
আলো লাগা ঝকঝকে স্রোত সাঁতরে ফেরে সোনালি আঁশ মহাশের। এক একটা আড়াই তিন
কেজি মাপের।
উত্তর পানে আধঘন্টা হাঁটলে সেতু। সেতু পেরিয়ে উঁচু টিলার উপর গরজিয়া দেবী
মন্দির। একান্ন পীঠের বাইরেও ভারতময় দুর্গাতিনাশিনী মন্দির। এও আরেক সংস্করণ। দুর্গা
মন্দির। নদীগর্ভে টিলার উপর দূর থেকে মন্দিরটাকে
দেখায় যেন তেকোণা নৈবেদ্য কেউ বসিয়ে গেছে আকাশের উদ্দেশে। ছেলেবেলার বৈশাখী মেলায় গোলাপি
রং চিনির মঠ । ব্রিজের নীচে তিমির ল্যাজের
আকার নিয়েছে কোশির নীল স্রোত। নুড়ি,বোল্ডার,সাদা বালি বিছানো তেকোণা
তিনটুকরো দ্বীপ। পূণ্যলোভী দর্শনার্থী, পূণ্যবিমুখ ট্যুরিস্ট নীচে নেমে ছেলেমানুষের
মতো উপুড় হয়ে বসে নুড়ি পাথর নিয়ে খেলে। গোড়ালি
জলে পায়ের পাতা ভিজিয়ে হেঁটে যায় যতটা যাওয়া চলে। পিঁপড়ের মতো লাগে শরীরগুলোকে। বাঁ দিকের গিরিমাটি রং পাহাড়ের দেয়াল খাড়া নেমেছে নদীগর্ভে। পপলার গোত্রের নিষ্পত্র
শীর্ণ ঢ্যাঙা গাছের সারি চলে গেছে উত্তরমুখো। ডান দিকের পাহাড়ে ঠাসবুনট তীব্র সবুজ।
এক আইরিশের চোখে দেখা ভারতবর্ষের কথা
মনে করিয়ে দেয় করবেট অরণ্য। তার কাছে থাকি অথবা দূরে। এখন যেমন লকডাউন বদ্ধ।
জানি না আর কখনও দেখবো কিনা। তিনবার এসেছি। তৃষ্ণা মেটেনি। ভুলতে পারবো না সেই মানুষটাকে। সামাজিক নিরাপত্তার ভরসা তাঁকে দিতে পারেনি
স্বাধীন ভারত। অনেক অভিমানেই দেশ ছেড়েছিলেন। জন্মভূমি তো দেশই। জন্মেছিলেন নৈনিতালে
। তেরো ভাইবোনের অষ্টম। এ দেশে আরেক অষ্টমগর্ভ
নিত্য পূজো পান। ইনিও কুমায়ুঁনের দেবতা। লেখক চিত্রপরিচালক মার্টিন বুথ এক গল্প
শুনিয়েছেন। কালাধুঙ্গিতে জিম করবেট ছবির শ্যুটিং (১৯৮৬?) চলাকালে একশো কিলোমিটার পথ
হেঁটে কার্পিট সাবকে দেখতে এসেছিলেন এক বৃদ্ধ। তিনি জানতেন কার্পিট সাব ফিরবেনই। নাম
ভূমিকায় অভিনয় করা ফ্রেড ট্রেভিস বাধ্য হন মিথ্যে অভিনয়ে। জিম করবেট-কে ভারতবর্ষ চিনিয়েছিল কালাধুঙ্গির অরণ্য।
১৯৪৭ নভেম্বর কেনিয়া চলে যাবার পাঁচ বছর বাদে প্রকাশিত My India উৎসর্গ
করেছেন সাবেক চল্লিশ কোটির ভারতের নব্বই শতাংশ
প্রান্তিক মানুষকে। যাদের নিবিড় সাহচর্যে ঘটনাবহুল জীবনের বাহাত্তরটা বছর
তাঁর কেটেছে । মুখবন্ধে জিম লিখেছেন ‘যদি এ
বইয়ে ভারত ইতিহাস খোঁজেন,অথবা যদি খোঁজেন ব্রিটিশ রাজের উত্থান পতন বৃত্তান্ত,যদি জানতে চান কেন এ উপমহাদেশ পরস্পর বিবাদমান দুটো খন্ডে টুকরো হল
এবং সে অঙ্গহানি সংশ্লিষ্ট টুকরো দুটোর উপর
সর্বোপরি এশিয়া মহাদেশের উপর কী প্রভাব ফেলবে এসবের উত্তর এ বইয়ের পাতায় নেই। আমার
সারা জীবন ভারতে কাটলেও ঘটনাপ্রবাহের এবং নটনটীদের এত কাছে ছিলাম যে
এসব ব্যাপারে নিরপেক্ষ দৃষ্টি বজায় রাখা কঠিন। আমার চেনা ভারতে চল্লিশ কোটি মানুষের নব্বই শতাংশ
সরল, সৎ, সাহসী, অনুগত, কঠোর পরিশ্রমী। ঈশ্বরের
কাছে অথবা সে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক তার কাছে এই মানুষগুলো প্রতিদিন প্রার্থনা করে
তিনি অথবা সরকার বাহাদুর যেন তাদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দেন। যাতে তারা মাথার
ঘাম পায়ে ফেলে দুটো খেয়েপরে বাঁচতে পারে। এই
মানুষগুলো যারা একেবারে ডাঁহা গরীব, কাগুজে ভাষায় ‘লাখো হাভাতে ভারতীয়’ এদেরই মাঝে আমার
দিন কেটেছে। এদেরই ভালোবেসেছি। এদেরই কথা আজ বলবো। আমার এই দরিদ্র ভারতীয় বন্ধুদের
হাতেই এই বই তুলে দিলাম’।