বৃষ্টি সন্ধানী ।।অমিতাভ সেনগুপ্ত ।।ধারাবাহিক অনুবাদ-১
(Chasing the Monsoon-Alexander Frater থেকে অনুবাদ)
(কপিরাইট- অমিতাভ সেনগুপ্ত ।।বাণিজ্যিক কারণে ব্যবহৃত নয়।)
(১)
প্রথম যে শব্দ
শুনি তা ছিল বৃষ্টি পড়ার। মনে হয় একধরনের ধাতব ভার ও ভর থাকে উষ্মমন্ডলীয় বর্ষার।
সেটাই অঝোর ঝরছিল যখন আমার মায়ের প্রসব ব্যাথা শুরু হয় দক্ষিণ-পশ্চিম
প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপের ছোটো মিশন হাসপাতালে। বৃষ্টি ঝরেই চলেছিল তাঁর প্রসব
কালে। আমি ভূমিষ্ঠ হবার কিছু পরেও শোঁ শোঁ আওয়াজে বাইরের ঘন পত্রগুচ্ছের আড়াল ঠেলে
ঝালাই করা লোহার ছাদে বাজনা বাজাচ্ছিল বৃষ্টি।
মাকে প্রসব
করাচ্ছিলেন আমার বাবা। যে কোনো দিকেই বহু হাজার মাইলের মধ্যে উনিই তখন একমাত্র
চিকিৎসক। সপ্তাহে বহুবার জরুরি কলে যেতেন মোটর বোটে । অধিকাংশ সময় প্রত্যন্ত
গ্রাম, জনবসতিতে রোগীর কাছে পৌঁছতে পাড়ি দিতেন দূর দূরান্ত। সুতরাং তাঁর কাছে নিছক
কৌতুহলের বিষয় ছিল না আবহাওয়া । ক্রমাঙ্ক করা কাচের বৃষ্টি মাপার যন্ত্র,
হাসপাতালের বাগানে রাখা লড়ঝড়ে বায়ুমানযন্ত্র দিয়ে বৃষ্টি মাপতেন এবং নোটবন্দী
করতেন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, রোদের ঘন্টা মিনিট, বাতাসের গতি ও নিশানা।
অনেক বছর বাদে
এসব নথির কথা বলতে গিয়ে বাবা বললেন যেদিন আমি জন্মাই সেদিন ২.১ ইঞ্চি বৃষ্টি হয়
সাত ঘন্টা বারো মিনিটের ব্যবধানে। ফুল ঝরে যায় গাছ থেকে। ধুয়ে যায় উপরের মাটি। ঝরে
পড়া ফুলের মিষ্টি গন্ধময় ভিজে গালিচায় ঢাকা পড়ে আমাদের ছোটো দ্বীপ। ঘিরে থাকা
অগভীর হ্রদের জলে ভাসে কয়েক টন দ্রবণশীল মাটির সর । মোটামুটি শান্তই ছিল সমুদ্র।
উতল হয়নি ঢেউ।
স্বভাবতই এসব ঘটনার সচেতন স্মৃতি আমার নেই । তবে মনে হয় তারা ছাপ রেখে গিয়েছিল। আসন্ন জাপানি আক্রমণের ভয়ে মরচে ধরা বুড়ো টহলদারি স্টিমারে চাপিয়ে মা আমি ও বোনকে অস্ট্রেলিয়া সরিয়ে নিয়ে যাবার আগে পাঁচ বছর ওই দ্বীপে কেটেছে আমার। স্টিমার যাত্রা শুরু করে হাল্কা বাতাসে। ভোর হবার আগের ভারী শিশিরে। পাঁচ বছরের পর্বে হাজার ঘন্টা বৃষ্টি এবং আবহাওয়ার চূড়ান্ত খামখেয়ালিপনার অভিজ্ঞতা হয়ে যায় আমার।
তুমুল বৃষ্টির
তোড় নিয়ে ট্রেনের মতো এসেছে গেছে উষ্ণমন্ডলীয় নিম্নচাপ। ফোর্স ৮ (আইরিশ
হাইড্রোলজিস্ট স্যার ফ্রান্সিস বোফার্ট আবিষ্কৃত বাতাসের গতি মাপক স্কেল- অনুবাদক
) ঝোড়ো বাতাস এবং তার পশ্চাদ্গামি অশান্ত সমুদ্রকে সবসময় উদার স্বাগত জানিয়েছি
আমি । শরীরে রোমাঞ্চ জাগাত দুর্নিবার ঝড়,বজ্রবিদ্যুতের পূর্বরঙ্গ । কিন্তু তাদের
খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে শেখান হয়েছিল আমাকে। বিদ্যুৎ ঝলক ও বাজ পড়ার ফাঁকের সেকেন্ডগুলো
পাঁচ সেকেন্ডে এক মাইল এই হারে গুনে (বিদ্যুৎ ঝলক ও বাজ পড়ার ফাঁকে সেকেন্ড গুনে
যে সময় তাকে ৫ দিয়ে ভাগ করলে মাইল মেপে পাওয়া যায় বজ্রবিদ্যুতের দূরত্ব। সেই
হিসেবে ৫ সেকেন্ড = ১ মাইল - অনুবাদক ),আগুয়ান ঝড়ের গতিবিধি অনুসরণ করে, সফেন
বর্ষা শুরুর পূর্বানুমান করা।
আরামপ্রদ,শীতল
বর্ষা বাড়ির ঘরগুলো ভরিয়ে দিত জল-ঝরা বাগানের গন্ধে। বোধহয় বায়ুমন্ডলীয় বিদ্যুত
প্রবাহ চাঁপা ও জুঁইয়ের রহস্যময় দমকা হাওয়া বইয়ে দিত ঘরে । সে সুগন্ধ বৃষ্টি থামার
পরও লেগে থাকত বাতাসের নানা ফাঁক ফোকরে। চারদিক উঁচু পর্দায় ঢেকে বাকি পৃথিবী থেকে
দ্বীপটাকে বিচ্ছিন্ন করে একাকীত্ব বোধের এই আবাহন আমার ভালো লাগত।
(ক্রমশ)