বৃষ্টি সন্ধানী ।।অমিতাভ সেনগুপ্ত ।।ধারাবাহিক অনুবাদ-৪
(Chasing the Monsoon-Alexander Frater থেকে অনুবাদ)
(কপিরাইট-
অমিতাভ সেনগুপ্ত ।।বাণিজ্যিক কারণে ব্যবহৃত নয়।)
(৪)
১৯৪১’র ভিজে
মরসুমে রান্নাঘরে ঢুকে বাবা জানালেন পার্ল হারবারে বোমা ফেলেছে জাপানিরা। সেদিন
মাঝারি দখিন বাতাস ছিল। মেঘের আচ্ছাদন ছিল হালকা (কাস্টিলেটেড অল্টোকিউমুলাস)। আগে
কখনও ওরকম বিবর্ণ, কম্পিত দেখিনি তাঁকে। রেগেও গিয়েছিলেন। হঠাৎ খুব উচ্চকিত হয়ে
উঠেছিল তাঁর স্কটিশ উচ্চারণ। তিনি জানতেন আমাদের দ্বীপের জীবন শেষ হবার সংকেত এ
ঘটনা। সেটা যদিও উপলব্ধি করিনি কিছুদিন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গুজব ছড়ায়। মালেকুলা’র
(প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ –অনুবাদক) এক আবাদকারী সন্ধের আঁধারে ইম্পিরিয়াল
নৌবহরের (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি নৌবহর- অনুবাদক) যুদ্ধ জাহাজদের নিঃসাড়ে
এগোতে দেখেছে ; তেজো’র পদাতিক সেনার জন্য মজুত তৈরি রাখতে স্যান্টো-য়
(প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপ- অনুবাদক) শয়ে শয়ে বাইসাইকেল নামিয়েছে ইয়োকোহামা’য়
রেজিস্ট্রি করা মালবাহী জাহাজ। ইফাতে (প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপ –অনুবাদক) দ্বীপে
লাভদায়ী গোলমরিচ বাগানের মালিক এক স্থানীয় জাপানি তার ক্রিস্টাল রেডিওতে (রেডিও
গ্রাহক যন্ত্র- অনুবাদক) টোকিও থেকে আসা আক্রমণের সাংকেতিক নির্দেশ নিচ্ছে।
বাড়ির পিছনে
রাঙা আলু খেতে পরিখা খোঁড়ান বাবা। তিনি নাম দেন বিমান হানার আশ্রয় কিন্তু খুব
শিগগিরি সেটা আরেক জলাশয় হয়ে যায়। অরূণ পদ্মের শিকড় গজায় এবং তারা বেড়ে ওঠে।
ব্যাঙেরা বাসা করে। যোগ দেয় এক প্রজাতির গোসাপ। আমাদের মালি বলে সে নিশ্চিত ওটা
সাম্প্রতিক কোনো বর্ষায় আকাশ থেকে পড়েছে। দক্ষিণ প্রশান্তমহাসাগরীয় সূর্যের শোষণ
ক্ষমতা এতই যে মনে হয় তা অতিকায় পাম্পের মতো সরাসরি সমুদ্র থেকে জ্যান্ত শুষে নিতে
পারে হিলহিলে বস্তু।
অবশেষে এক
গভীর রাতে শোনা গেল বিমানের আওয়াজ। বিছানা থেকে উঠে হামাগুড়ি দিয়ে বিমানহানা
আশ্রয়ে পৌঁছই আমরা। খুব রোমাঞ্চ হচ্ছিল তাই কোনো অস্বস্তি বুঝিনি। ধীরে কর্কশ
আওয়াজ করছিল জলাশয়ের জীবন। জল ছেটাচ্ছিল চারপাশে। আমি উপরে তাকালাম।
‘একটাই মাত্র ছিল’- কিছুক্ষণ বাদে বাবা বলেন। যে বিষয়ে বলছেন তা তিনি জানতেন। বিদেশে এয়ারোপ্লেন দেখেছেন। এখানে তা অজানা। আমি এবারই প্রথম দেখলাম। তার চেয়েও পাগল করা ছিল চাঁদহীন কালো আকাশ। একটা তারাও দেখা যাচ্ছিল না। অন্য রাতে এত তীব্র উজ্জ্বলতা ছড়ায় তারারা যে ওই আলোয় সূচে সুতোও পড়ানো সম্ভব। আজ রাতে সবকিছু ঢেকে দিয়েছে উঁচু সিরোকিউমুলাস মেঘ।
‘ সম্ভবত জিরো ( মিৎশুবিশি A6M Zero যুদ্ধবিমান –অনুবাদক) ‘- বাবা বলেন –‘ বোধহয় চক্কর মারছে’।
তিনশো গজ দূরে আবাসনের মাঠ থেকে চমৎকার এক আলোক শিখা হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে আকাশে । রুলারের মতো সোজা প্রত্যয়ী যেন সেটা বায়ুমন্ডল চিড়ে উল্কা বার করে আনবে।
‘ডিকি সার্চালাইট চালু করেছে’ – মা’র গলায় বিস্ময়।
প্রথমটায় ঢেউ খেলে,কাঁপে ডিকি’র আলো। নিয়ন্ত্রিত হতেই চিরুনি তল্লাশি চালায় আকাশে। হঠাৎ দেখা যায় প্লেনটাকে। মাথার অনেক উপরে রূপোর ছোটো ঝিলিক। আবাসনের মাঠ থেকে দুটো প্রচন্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা যায়। আফ্রিকায় বড়ো জানোয়ার শিকার করেছে ডিকি। এখন তার হাতি বন্দুকের (বড়ো জানোয়ার মারার জন্য তৈরি বড়ো ক্যালিবারের বন্দুক- অনুবাদক) দুটো ব্যারেল খালি করে অনুপ্রবেশকারীর উপর। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় গুলি। আমরা শুনতে পাই উত্তরে বিমানবাহী জাহাজের দিকে উড়ে পালাচ্ছে জাপানি বিমান। আলোক- রশ্মি গুটিয়ে আনে ডিকি। নিভিয়ে দেয় সার্চলাইট।
সেই শুরু।
এবার গুজবগুলো জরুরি ও গ্রহণযোগ্য করে বিশ্বস্ত সংবাদসংস্থা। তিন সপ্তাহ বাদে
গুবরে পোকা থিকথিক টহলদারি স্টিমারে তুলে আমাদের অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দেন বাবা।
বিদায় জানাতে আসে বিরাট জনতা। ব্রিটিশ এবং ফরাসি সরকার অর্ধ শতাব্দী যুগ্ম শাসন
করেছে নিউ হেব্রাইডস (দক্ষিণ প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপসমষ্টি সাবেক নিউ হেব্রাইডস
কন্ডোমিনিয়াম । এখন রিপাবলিক অফ ভানুয়াতু –অনুবাদক)। দু’পক্ষের কেউই সেখানে একটা
স্কুল পর্যন্ত খোলেনি। এখানে আসার পর এই সমস্যাটা মেটাতে সচেষ্ট হন মা। তাঁর
অবেক্ষণে পাতার ছাউনি দেওয়া তাঁবু বানাবার ব্যবস্থা হল। নিজেদের ডেস্ক বানাতে
ছাত্রদের পাঠালেন জঙ্গলের কাঠ আনতে। অত ভোরে জেটিতে এসেছিল একশোর বেশি মানুষ। ওরা
ছিল দ্বীপের একমাত্র আদিবাসী যারা পড়তে লিখতে জানত ।
আমাদের বৃদ্ধ
মালি আমুদে মোজেস ছিল এই দলে। আমি যে এক জনপ্রিয় বৃষ্টি দেবতার অবতার এটা ভাবতে
আমাকে বারবার উৎসাহিত করেছে মোজেস । মুরগির অন্ত্র পরীক্ষা করে সেইসঙ্গে আমার পিঠে
কাঁকড়ার মতো জন্ম-দাগটা দেখে ওর এমন সিদ্ধান্ত। কথাটা এত ভালো লেগে যায় আমার যে
মনে হয়েছিল বিনা প্রশ্নে এটাকে সম্ভাব্য পেশা হিসেবে বাছা যেতে পারে । ( পরে
ব্যাপারটার দায়িত্ব নিলেন মেলবোর্ন স্কুলের বাইবেল স্টাডিস-এর এক অবিশ্বাসী
শিক্ষক)। খুব কঠিন ছিল মোজেসকে বিদায় জানানো।
(৫)
অস্ট্রেলিয়া
যাবার পথে একটা বড়ো নিম্নচাপের পেটের ভিতর দিয়ে যেতে হয় আমাদের স্টিমারকে। ঝোড়ো
হাওয়ার গতি ছিল ৫০ নটস (ঘন্টায় ৯৩ কিমি -অনুবাদক)। উথোলপাতাল সফেন ঢেউ। উড়ন্ত
স্প্রে ঝাপসা করে দিচ্ছিল বাতাস। আমার তখন জিভ বেরিয়ে যাওয়া কুকুরের দশা। তবু
আবহাওয়ার নোটস নিই, ব্যারোমিটার রিডিং রাখি একটা জবর চিঠি যাতে লিখতে পারি বাবাকে।
মেলবোর্ন এক
নতুন বিস্ময় হাজির করে –শীত। সত্যি বলতে খুবই হাল্কা শীত (মজা করে একবার একটা
স্থানীয় রেডিও স্টেশন খবর করে কলিনস স্ট্রিটে বরফ পড়ছে। তুলকালাম কান্ড বেধে গেল
)। শৈত্য বিচিত্র অনুভূতি । অস্বস্তিকর। আগে কখনও আমি কাঁপিনি । কম্বলের নীচেও
শুইনি। কম্বলের ভারে স্বপ্ন দেখতাম আমি কবরে শুয়ে আছি আমাকে মাটি চাপা দেওয়া
হয়েছে।
বিদ্যুৎ
চমকাতে দেখি বাজ পড়ে না। বিদ্যুৎ ঝলকানির পর অখন্ড নীরবতা। বিফল গোনা কয়েকশো
সেকেন্ড। মূক হয়ে থাকে আকাশ।
ঠান্ডা বৃষ্টি হয়। প্রায়ই খুব মিহি ও কৃপণ। কিন্তু দেশটার ঊষর মধ্যভাগ থেকে আসা স্কুলের একটা ছেলের চোখে এই কৃপণ বৃষ্টিই খুব অভিনব । ওরা যেখানকার সেখানে বছরের পর বছর ছিটেফোঁটা বৃষ্টি পড়ে না। যে গরম ওরা সহ্য করত তাতে দেশলাই বাক্স মাটিতে পড়লে ফেটে আগুন ধরে যেত। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার শীত ভালোবাসত ছেলেটা। শীত ওকে স্বাস্থ্যবান উদ্যমী করেছিল । হয়ত একই উপকার আমারও করে থাকবে শীত। যদিও কিছুদিন শীতের কারণেই বেড়ে গিয়েছিল আমার ঘরকাতুরেপনা । ঠান্ডার জন্য অভিযোগ করে বাবাকে চিঠি লিখলে জবাবী চিঠিতে আমাকে উত্যক্ত করত বাবা । আমার হাস্কি কুকুরগুলোর (একধরনের সাইবেরীয় কুকুর –অনুবাদক) খবর নিত, আমি পেমিকান (শুখনো চর্বি,শুখনো মাংস, শুখনো বেরি মিশিয়ে তৈরি পুষ্টিদায়ক খাবার- অনুবাদক) খাওয়া পছন্দ করছি কিনা জানতে চাইত। তারপর দেখিয়ে দিত মেলবোর্ন আর পর্তুগালের ওপোরতো দুটো শহরেরই তাপমান মাঝারি। ওপোরতো বিখ্যাত তার চমৎকার আঙুর আর অনুকূল জলবায়ুর জন্য। সে অর্থে আমি খুব একটা খারাপ নেই।
আমাদের
দ্বীপের খবরও দিত বাবা। জাপানি নয় দ্বীপের দখল নিয়েছে আমেরিকানরা। আগে পৌঁছে গিয়ে
বিনা ঝঞ্ঝাটে জাপানিদের সলোমনস দ্বীপপুঞ্জে (পাপুয়া নিউগিনির পূর্বে
প্রশান্তমহাসাগরে ছ’টা বড়ো দ্বীপের সমষ্টি - অনুবাদক) গর্তবন্দী করে ফেলেছে
আমেরিকানরা। এফাতে দ্বীপে ( রিপাবলিক অফ ভনুয়াতুর সবচেয়ে জনবহুল দ্বীপ। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান নৌঘাঁটি -অনুবাদক ) বাবার হাসপাতালের কয়েকশো গজ দূরে বিরাট
আমেরিকান নৌঘাঁটি । অঢেল ফ্রায়েড চিকেন, গুঁড়ো কফি, পেল্লাই সাইজের বিফ স্টেক দিয়ে
ওরা আপ্যায়ন করছে বাবাকে। এত নরম বিফ স্টেক যে কাঁটা চামচ দিয়েই কেটে ফেলা যায়।
বাবার চিঠিতে বিস্ময়ের সুর । ডেস্ক থেকে মুখ তুলে দেখতে পায় যুদ্ধজাহাজগুলো দ্রুত
বন্দরে ঢুকছে বেরচ্ছে ; যুদ্ধবিমান উড়ছে সর্বত্র ; বাবার জানলার নীচে ঢিল ছোঁড়া
দূরত্বে দুধের ফেনার মতো জল কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে ক্যাটালিনা ফ্লাইং বোটগুলো ( হাল
লাগানো আমেরিকান সি-প্লেন। জলে নামতে সক্ষম –অনুবাদক)। তবে অন্য কথাও লিখত বাবা ঃ
রোদ বৃষ্টির কথা, দক্ষিণ থেকে ধেয়ে আসা চমক লাগানো ডাকাতে বাতাসের কথা, তান্না
দ্বীপ ছাড়িয়ে জলস্তম্ভ দেখার খবর, আমাদের হ্রদের অনুপ্রভা বৃদ্ধি পাবার খবর,
আকর্ষক রামধনুর খবর যার ন’ডিগ্রি বাইরের সুক্ষ দ্বিতীয় বলয়ের সাতরং বিপরীতমুখী।
স্বভাববিরুদ্ধভাবে
খুব দ্রুত এসব খবর পরিবেশন সেরে ফেলত বাবা। আবহাওয়ায় আগ্রহ বোধহয় কমে আসছিল।
লক্ষ্য করলাম হারিকেনের থেকে প্রথম পান করা মিন্ট জুলেপ-এর (ককটেল –অনুবাদক)
বর্ণনায় বেশি উৎসাহী হয়ে উঠছে বাবা । হারিকেনের খবর করেছিল একটা অস্ট্রেলীয় কাগজ।
আমাদের দ্বীপ ছোঁবার পর হারিকেনের পশ্চিম চূড়ার (পরিভাষায় ‘ cod of the track’)
সম্ভবত মনে হয়েছে বাবাকে কব্জায় নিয়ে এসেছে আমেরিকানরা । যেভাবে ওরা বাবাকে খাবার,পানীয়,
বই উপহার দিচ্ছে, ঠাট্টা ইয়ার্কি করছে, সিনেমা ও অন্যান্য শো-তে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে
তাতে আমার খুব হিংসে হচ্ছিল। নৌঘাঁটিতে অ্যান্ড্রুজ সিসটারস-দের (১৯৪০’র দশকের তিন
জনপ্রিয় মার্কিন গায়িকা -অনুবাদক) লাইভ শো দেখছে, থ্যাঙ্কস গিভিং নৈশভোজে রোস্ট
টার্কি খাচ্ছে বাবা। টার্কি ! দক্ষিণ প্রশান্তমহাসাগরে ! ভাবা যায় ! মোটর বোট সফরে
মানচিত্রে না থাকা বিপজ্জনক ডুবো পাহাড়ের চূড়ো দেখতে পেয়ে সেটার বিষয়ে আমেরিকানদের
সতর্ক করেছিল। মার্কিন নৌবহরের সংশোধিত চার্টে ডুবোপাহাড় চূড়োয় বাবার নাম ছাপে
আমেরিকানরা।
সেবা ও
আত্মত্যাগের আদর্শে বেড়ে ওঠা লাজুক গরিব তরুণ স্কটসম্যান বাবা পার্থিব জীবনে খুব
সামান্য পুরস্কার প্রত্যাশী হতে শিখেছিল (সব তোমার পরজন্মের জন্য তোলা আছে)। এহেন
বাবার অবশ্যই চোখ ধাঁধানো লেগে থাকবে আমেরিকানদের । বাবার পরিবর্তনের জন্য তাদের
তখন দোষী করেছি ছিদ্রান্বেষীর মতো। আজ জানি ইচ্ছে করেই হাল্কা চালে মুখরোচক ঢঙে
চিঠিগুলো লিখত বাবা। বস্তুত খুব খারাপ দিন কাটছিল তার। শ্ত্রুর বন্দুকের নীচে কাজ
করতে হয়নি। সমস্যার মোকাবিলা করেছে সংসার সীমান্তে। হাম মড়কে মারা যায় অসংখ্য
অগুন্তি আদিবাসী বাচ্চা । কোনো সহজাত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকায় দলে দলে মরছিল
ওরা। দ্বীপ থেকে দ্বীপে ঘুরে রক্তস্ফোট, গালের ভিতর কপলিক স্পট ( মুখের ভিতর ছোটো
যে দাগগুলো হামের পূর্বলক্ষণ –অনুবাদক) লক্ষণ দেখে বেড়ায় বাবা। শিশুদের চোখের জন্য
বোরাসিক লোশন, পেটের জন্য বিসমাথ (ডায়েরিয়া চিকিৎসায় ব্যবহার হয় -অনুবাদক) ও আফিম
রাখে লঞ্চ বোঝাই । নিউমোনিয়া প্রতিষেধক সালফোনামাইডস এবং এপসম সল্টও থাকে। অধিকাংশ
ক্ষেত্রে হামের পর পরই আসত নিউমোনিয়া।
অ্যান্টিবায়োটিক তখনও বেরোয়নি। সালফোনামাইডাস বাবার মহৌষধ। তবে আজকের নিরিখে অলৌকিক ঘটাবার ক্ষমতা তাদের ছিল না । সূচের ভিতর দিয়ে শরীরে ঢোকা সেরাম-এ বিপুল আশা রাখতে হত চিকিৎসককে । পেনিসিলিন এসে পড়ার সেরা রোমাঞ্চক ঘটনা বাবার বারান্দায় আমেরিকানদের ক্রেটবোঝাই পেনিসিলিন যাওয়া। অরিগ্যামি কাগজের মতো দেখতে সেনসর করা একটা চিঠিতে ( দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সামরিক বাহিনীর লোক এবং পোস্টঅফিস চিঠি সেনসর করত -অনুবাদক) বাবা লিখেছে নিউমোনিয়া,মেনেঞ্জাইটিস, ফোঁড়ার চিকিৎসায় কাজে লাগলেও ম্যালেরিয়া সারায় না পেনিসিলিন। প্রতি তিন ঘন্টা অন্তর ১০,০০০ অক্সফোর্ড ইউনিট ইনজেকশন দিতে হবে। মাছের মতোই আইসবক্সে রাখা সত্ত্বেও নষ্ট হত ইনজেকশন।
হামের পর এল
ফ্লু মহামারি। তারপর আবার একপ্রস্থ হাম মহামারি। পরে বাবার মুখে শুনেছি একটা সময়
মনে হয়েছিল বুঝি বিলুপ্ত হয়ে যাবে গোটা দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী জনসংখ্যা। এটা একটা
দুঃস্বপ্নের মতো বারবার ফিরে আসছিল।
এরমধ্যে মিশন
হাসপাতালে সলমনস দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে মিত্রশক্তির আহত সৈন্যদের আসা
নিয়মিত জারি থেকেছে । আমেরিকানদের নিজেদের হাসপাতালে আর জায়গা ছিল না। বাবাকে তারা
ওষুধ, যন্ত্রপাতি,এবং বারবন হুইস্কির কেস পাঠাত। এক সকালে আমাদের মালি মোজেস জানায়
তার জ্বর আর কানের উপর একটা অদ্ভুত মাংসপিন্ড গজিয়েছে। কুষ্ঠ নির্ণয় করে তাকে
মুগ্রল ইনজেকশন দেয় বাবা। কিন্তু তার ফ্লু ধরনের জটিলতা দেখা দিল এবং কয়েক
সপ্তাহের মধ্যেই মারা যায় মোজেস। অল্পকিছুদিন বাদে গুলিতে নামিয়ে আনা এক জাপানি
নিরীক্ষক পাইলটকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় মিশন হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সে লুকনো
হ্যান্ড গ্রেনেডের পিন টেনে খুলে ফেলে। তার উপর ঝুঁকে ছিল মেট্রন স্বর্ণকেশী মলি
যে আমার জন্মের সময় সাহায্য করেছিল বাবাকে । ছানি কাটানো অপারেশনের জোগাড় করতে
মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগেই সেখান থেকে চলে এসেছিল বাবা।
(৬)
মেলবোর্নে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছিলাম। ভালো লাগছিল মরশুমি দাবানল, অস্ট্রেলীয় টোস্টেড ওয়াফেল (কেক জাতীয় খাবার-অনুবাদক)। আমার পোর্তুগিজ বংশোদ্ভূত বিজ্ঞান শিক্ষক জানান সত্যিই ওপোরতো’র আবহাওয়া মেলবোর্নের মতো। ইউরোপের সর্বত্র তার মনোরম সুষম জলবায়ুর সুখ্যাতি।
মেলবোর্নে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছিলাম। ভালো লাগছিল মরশুমি দাবানল, অস্ট্রেলীয় টোস্টেড ওয়াফেল (কেক জাতীয় খাবার-অনুবাদক)। আমার পোর্তুগিজ বংশোদ্ভূত বিজ্ঞান শিক্ষক জানান সত্যিই ওপোরতো’র আবহাওয়া মেলবোর্নের মতো। ইউরোপের সর্বত্র তার মনোরম সুষম জলবায়ুর সুখ্যাতি।
স্কুলে কেউ আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে আমার আগ্রহের অংশীদার হয়নি। ফলে যথাকালে আমি তা ছেড়ে দিই এবং অন্যত্র মনোনিবেশ করি।জাপানের আত্মসমর্পণের পর অস্ট্রেলিয়া চলে আসে অসুস্থ, বিধ্বস্ত বাবা । তার দীর্ঘ বিশ্রাম দরকার। আর্থিক অবস্থাও শোচনীয়। ফিজি স্কুল অফ মেডিসিনের অধ্যক্ষ পদে ভালো মাইনের চাকরি নিল সঙ্গে সঙ্গেই। দ্বীপবাসীদের জন্য প্রাথমিক শল্যচিকিৎসা, ধাত্রীবিদ্যা, জনস্বাস্থ্য এবং ট্রপিক্যাল মেডিসিনের চার বছরের পাঠক্রম ছিল প্রতিষ্ঠানটির। ব্যবহারিক কারণে পাঠক্রমে আবহবিদ্যাও রাখতে বলি বাবাকে। তার ছাত্ররা কোনোদিন তাদের নিজস্ব মোটর লঞ্চ সফরে যেতে পারে প্রান্তিক প্রবালদ্বীপগুলোয়। মজা পেয়ে বাবা যা জবাব দিল তাতে নিশ্চিত হওয়া গেল পুরোনো উদ্দীপনা এখন আর নেই।
নিউ হেব্রাইডস
দ্বীপপুঞ্জের বিচ্ছিন্নতা স্বনির্ভরতা তৈরি করেছিল ; বাবাকে একরকম আচ্ছন্ন খেলোয়াড়
বানিয়েছিল খামখেয়ালি, ক্ষমাহীন আবহাওয়া । এক চঞ্চল প্রতিপক্ষর থেকে নিজেকে এগিয়ে
রাখতে সর্বদা খেলার উপর নজর রাখতে হয়েছে। কিন্তু এখানে ফিজির ব্যস্ত রাজধানী
সুভা-য় সরকারি বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন। তাদের উন্নতমানের যন্ত্রপাতি আছে। তারা তোমার
কাজ করে দিচ্ছে। রেডিওতে রোজ পড়ে শোনানো হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের পুর্বাভাস। বাবা তা
শোনে অর্ধেক কান দিয়ে। পিছনে ফেলে এসেছে তার মহাকাব্যিক ছোটো বোট সফরগুলো।আর
কোনোদিন পৃথিবীর সিক্ততম জায়গা চেরাপুঞ্জী যাবার কথা বলেনি বাবা।
তুঙ্গী বর্ষায়
চেরাপুঞ্জী থেকে অদূরে কোহিমায় জাপানিদের সঙ্গে হিংস্র লড়াইয়ে নিহত হয় বাবার বন্ধু
ওয়াপশট। পুরোনো ডেপুটি ব্রিটিশ কমিশনারের বাংলোর ঘাসের টেনিস লনের নীচে শায়িত তার
দেহ। আমি অবাক হয়ে ভেবেছি ওয়াপশটের মরদেহও কি মধুতে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল।
বাবাকে একটা পদক
দেয় ব্রিটিশরা। এই পদক এবং তার পুরোনো স্মার্ট অ্যান্ড ম্যাসন ব্যারোমিটার আমার
কাছে রেখে গিয়েছিল বাবা। ছোটো চামড়ার বাক্সে রাখা পদকটা। বাক্সের উপর লেখা MBE
CIVIL। পদকটা রূপোর Maltese cross। শীর্ষে মুকুট। গলদা চিংড়ি রঙের রিবন থেকে
ঝোলানো। রিবনের রং এখন বিবর্ণ । একটা কাগজে ছাপা Most Excellent Order of the
British Empire’ । ফিফথ ক্লাস দেওয়া হয়েছিল বাবাকে। কেন সিভিল সার্ভিস অ্যাওয়ার্ডস
কমিটি বাবাকে ফোর্থ ক্লাস দিতে পারল না, এসব পুরস্কারের যোগ্যতামান কী আমি অবাক হই
ভেবে। কাগজে আরও লেখা ছিল পদকধারীর মৃত্যু হলে তার জীবিত আত্মীয়রা মৃত্যুর দিন
জানিয়ে Central Chancery of the Orders of Knighthood , St.James’s Palace,
London,SW1 এই ঠিকানায় যেন চিঠি লেখে ।
বাবার যখন সময়
হল কাজটা যথাযথভাবেই করেছিলাম আমি। (ক্রমশ)