বৃষ্টি সন্ধানী ।।অমিতাভ সেনগুপ্ত ।।ধারাবাহিক অনুবাদ- পর্ব-২
(Chasing the Monsoon-Alexander Frater থেকে অনুবাদ)
(কপিরাইট- অমিতাভ সেনগুপ্ত ।।বাণিজ্যিক কারণে ব্যবহৃত নয়।)
(২)
বিষয়টা নিঁখুত
ধরেছিল আমার বিছানার পাশে টাঙানো একটা ছবি । ফ্রেমে বাঁধানো খুব উজ্জ্বল রঙের
এডওয়ার্ডীয় ছাপাই ছবিটা তৃণাচ্ছাদিত উঁচু পাহাড়শ্রেণী ডুবিয়ে দেওয়া এক প্লাবনের
দৃশ্য। চূড়ার মন্দির সারি বোঝায় এ দৃশ্য প্রাচ্যের। নীচের ছোটো ছোটো বনে চেনা যায়
বাঘ ও বর্শাধারী উলঙ্গ পিগমিদের । কিছু জায়গায় পিগমিদের এড়িয়ে যাচ্ছে বাঘেরা; কিছু
জায়গায় বাঘেরা তাড়া করেছে পিগমিদের। ছবিটাকে অসাধারণ করে তোলে বৃষ্টির ভার, তার
ঘনত্ব। ছুটে চলা নীচু মেঘ থেকে নেমে আসা মূষলধারা জল অগুন্তি প্রপাত হয়ে লাফিয়ে
পড়ছে পাহাড় থেকে । বাতাসে ত্রিকোণ পালের মতো ঝুলে আছে পাখসাট মারা জলের চাদর ।
বেশিটা ছড়িয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের ঢালে। ছবির অদ্ভুত ঘনশ্যাম অস্বচ্ছতা আভাস দেয় এক
হ্রদের তলদেশে তার নিসর্গ ডুবিয়ে দিয়েছেন শিল্পী এল.জিও.লোপেজ ।
সাবলীল খোদিত ক্যাপশনে লেখাঃ ’চেরাপুঞ্জী আসামঃ পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিস্নাত এলাকা’।
অনুপম
শিল্পকর্মটি আমার মাবাবার বিবাহের উপহার। আমার উপর এত গভীর প্রভাব ফেলেছিল এ ছবি
যে পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়ায় যুদ্ধ- উদ্বাস্তু আমার ঘরকাতুরে বালাইয়ের উপশম হয়েছে
তার স্মৃতি। মনের চোখে ছবিটার একটা মূর্তিসদৃশ চাপা প্রভা ছিল যা এমনকি আমার স্কুল
ডরমিটরির অন্ধকারও হাল্কা করেছে।
বাবাও প্রশংসা করতেন ছবিটার । তিনি বলতেন ছবিটা ঊর্দ্ধগামী গরম বাতাস ও নিম্নগামী ঠান্ডা বাতাসের আলোড়ন পর্যবেক্ষণ। সেইসঙ্গে পৃথিবীর ভারীতম বর্ষণ তৈরি করা ভারতীয় মৌসুমী বাতাসের ছবি। সম্ভবত অজান্তেই শিল্পী এল.জিও.লোপেজ যা এঁকেছেন সেই মাত্রাতিরিক্ত বর্ষণ আমরা দেখি যখন আবহমন্ডলের ঊর্দ্ধ বলয় উঁচু পাহাড়সারির উপর সঞ্চরনশীল। বাবা বলতেন- ‘একটু ত্যারছাভাবে ভ্রাম্যমাণ মেঘ’। বিষয়টা ভালো বুঝতেন তিনি । বাবাকে ছবিটা দেন গ্লাসগো’র এক পুরোনো বন্ধু ওয়াপশট। চেরাপুঞ্জিতে স্কটল্যান্ড মিশনারিদের এক চার্চে তিনি কাজ করতেন। বাবার সঙ্গে তাঁর বন্ধুর চিঠিপত্রের অধিকাংশ ছিল আবহাওয়ার খবর বিনিময়। ওয়াপশটের পাঠানো কিছু বৃষ্টির পরিসংখ্যান এমনকি বাবাকেও স্তব্ধ করে দিত। একদিনে পঁয়ত্রিশ ইঞ্চি ! কবর দেওয়া যেত না জলমগ্ন জমিতে। বুনো মধুর ভাঁটিতে চুবিয়ে রাখা হত মরদেহ যতক্ষণ না যথেষ্ট শুকিয়ে উঠছে মাটি । ওয়াপশটের ভাষ্য অনু্যায়ী লেবুর হাল্কা গন্ধময় মধুতে ডুবনো দেহগুলো ইল মাছের মতো চকচকে পিচ্ছিল হয়ে যেত। তখন খুব কঠিন হত সেগুলো নাড়াচাড়া করা।
প্রায়ই
চেরাপুঞ্জী যাবার কথা বলতেন বাবা। আবহাওয়ার পরিভাষায় চেরাপুঞ্জী ছিল বাবার কাছে
স্টেশনস অফ দি ক্রস গোত্রের এক পূণ্যভূমি (জিশুর মৃত্যুদন্ড পাওয়া, ক্রুশবিদ্ধ
হওয়া, ক্রুশে তাঁর মৃত্যু এবং তাঁর দেহ সমাধিস্থ হওয়া অবধি চোদ্দোটি পর্বে বিভক্ত
ছবি যাকে Stations of the Cross অথবা Way of the Cross বলা হয়। জেরুজালেমে রোমান
গভর্নর পাইলেট-এর বাড়ি থেকে যে পাহাড়ে ক্রুশবিদ্ধ হন জিশু সেদিকে যাবার পৌরাণিক
পথে চোদ্দোটি পবিত্র স্থানে প্রার্থনা করেন খ্রিস্টানরা -অনুবাদক)। তিনি বোঝাতে চাইতেন
ভরা বর্ষায় বৃষ্টি-মাপক নিয়ে চেরাপুঞ্জী যেতে পারা তীর্থ করার সমতূল্য। (ক্রমশ)