বৃষ্টি সন্ধানী ।।অমিতাভ সেনগুপ্ত ।।ধারাবাহিক অনুবাদ-৫
(Chasing
the Monsoon-Alexander Frater থেকে অনুবাদ)
(কপিরাইট-
অমিতাভ সেনগুপ্ত ।।বাণিজ্যিক কারণে ব্যবহৃত নয়।)
প্রথম
অধ্যায়
১৯৮৬’র শরতে
উদ্ভট কিছু ঘটনাস্রোত চিনা তুর্কিস্তানের মরুদ্যান, লন্ডনের টিচিং হাসপাতাল ঘুরে
চেরাপুঞ্জীর দিকে আমায় পথ দেখায় বাবার পরিবর্তে ।
সড়কপথে
যাচ্ছিলাম পাকিস্তান থেকে পশ্চিম চিনের কাশগড়। সদ্য খুলে দেওয়া কারাকোরাম হাইওয়েতে
শুরু তিন দিনের যাত্রা । ৪৭০ মাইল দীর্ঘ একসারি ঊর্দ্ধমুখী গিরিপথ কারাকোরাম
হাইওয়ে প্রাচীন সিল্ক পথের একটা শাখা অনুসরণ করে চলে চিন সীমান্ত অবধি । মায়াবী উপত্যকা
হুনজা’র মাঝ দিয়ে নিয়ে যায় আমাদের। পাকধরা বাজরা খেত বিকেলের রোদে গোলাপি। আখরোট
গাছের সারিতে পতপত করে ওড়ে সিল্কের উজ্জ্বল কেতন। পেরিয়ে যাই পৃথিবীর সুন্দরতম
পর্বতগুলোর একটা রাকাপোশি ; দুধারে তার অগুন্তি ছোটো গিরিশ্রেণীর কুচকাওয়াজ। সাবেক
তারকা শিল্পী যেমন কোরাস দল নিয়ে গাইতেন প্রেক্ষাগৃহে তেমন লাগে রাকাপোশিকে।
খুবানি কিনতে থামা একটা ছোটো চুনি খনির কাছে। চাহিদা থাকলে তবেই কাজ হয় খনিতে।
এখানে মধ্যযুগের এক দুর্গে পথশুল্ক দিতে হত সিল্করোড সফরকারীদের। যারা দিতে পারত
না তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল গার্নেট বুলেট ( সিলিকেট খনিজ গাঢ় রক্তাভ গার্নেট সীসায়
মুড়ে বন্দুকের বুলেট হিসেবে ব্যবহার হয়েছে এশিয়া ও দক্ষিণপশ্চিম আমেরিকায়
–অনুবাদক)।
অসংখ্য
খানাখন্দ ভরা কারাকোরাম হাইওয়েতে ফর্মুলা ওয়ান গতিতে ছুটছিলাম আমরা । রক-ফল এড়াতে
এলোপাথাড়ি গতি পরিবর্তন করছিল আমাদের গাড়ি। খাড়া পাহাড়ের মুখ অবিচল রাখার
প্রযুক্তি পাকিস্তানের না থাকলে কী হবে ওদের প্রচুর সাইন-রাইটার। এ রাস্তার
প্রত্যেক জায়গায় আগুয়ান বিপদের সতর্কবার্তা দিচ্ছে বাহারি রঙিন নোটিশ। কাঁপুনি
ধরানো খুনজেরাব পাস পেরিয়ে ১২০০০ ফিট উচ্চতায় বরফজমা চিনা গম্বুজের উপর দিয়ে চলা।
একপাশে কুনলুন পর্বতশ্রেণী, অন্যদিকে পামির, আমাদের সামনে স্ফীত রাজকীয় কারাকোরাম
পর্বতমালা। মানুষের চোখ মনে হয় এত বিশাল নিসর্গকে জায়গা দিতে অক্ষম ; আমার
মস্তিষ্কে পাঠানো অতিকায় বার্তাগুলোর ব্যাখ্যা চেয়ে বার বার ফেরাই অবিশ্বাসে।
ঢেউ খেলানো পাথুরে রাস্তায় গাড়িগুলো খুব জোরে চালাচ্ছিল ড্রাইভাররা। পাহাড়ি ঝোরা
পেরোতে গতি কমাচ্ছিল,খ্যাপাটে গর্ত বোঝাই ইয়াক চারণভূমির দীর্ঘ ঘুরপথে যেতে গিয়ে
নয়। তাকলামাকান মরুভূমির দিকে নামতে ঢুকে পড়ি ভূমিকম্প ঝাঁকানো, ডিনামাইট বিক্ষত
ভাঙা পাথর ভরতি নির্জনে। সেখানে রাস্তা তখনও তৈরি হচ্ছে খুব এলোমেলোভাবে। দেখে মনে
হবে যেন একসঙ্গে অনেকগুলো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রকল্প পরীক্ষা করা হচ্ছে। যে জায়গাগুলো
সবে পরিষ্কার করে গেছে একদল বুলডোজার তাদের প্রতিপক্ষরা এসে সেগুলো ঘেঁটে দিচ্ছিল।
যে জায়গাগুলো কষ্ট করে সাফ করেছে বিরোধী দলেরা সে জায়গাগুলোতেই পাথর ঢালে পথরোধ
করা গ্যাং-লেবার (এরা নাকি সবাই সাজা পাওয়া আসামী জানায় আমাদের ড্রাইভার)। বাতাস
ধূলোয় ভরিয়ে,বিপদ ও ধূমায়িত অসন্তোষ তৈরি করে বিন্যস্ত করার বদলে দৃশ্যপটের
প্রাগৈতিহাসিক বিশৃংখলা শুধু বাড়িয়েছে পরস্পর যুযুধান লেবার গ্যাং।
আমরা যেদিক
যাবো সেই উত্তরপশ্চিমমুখী চলেছে বোল্ডার খন্ড, উল্টনো লরি ঠেলে নিয়ে যাওয়া
বুলডোজারগুলো। আমরা পিছন পিছন যাই। যেসব লরির ড্রাইভাররা উত্যক্ত করে, নীচের
নদীখাতে আমাদের গাড়িকে ফেলে দিতে চায় তাদের কাটিয়ে যাই । তাদের খেলাটা জানে আমাদের
ড্রাইভার। ফোর হুইল ড্রাইভ দক্ষভাবে ব্যবহার করে ঠিক সরে যায় লরি চালকদের নাগালের
বাইরে । অমসৃণ বাসাল্ট পাথরের উপর ছেঁচড়ে বেরোবার চেষ্টায় ঘন্টার মতো বাজে গাড়ির
নীচের অংশ।পথের শেষটুকু তাকলা মাকান মরুভূমির বন্য ঢেউখেলানো চড়াইউৎরাইয়ে ঘন্টায়
৮০ মাইল বেগে ছোটে গাড়ি। ব্যাথায় কাতর, ধূলিধুসর আমরা সবাই কাশগরে নেমে তরমুজ খাই।
এক পেনি তাদের দাম এবং এত অপর্যাপ্ত যে বাতাসে তরমুজ গন্ধ ঝুলে থাকে। বেশকিছুদিন
কাশগড়ে কাটিয়ে একইভাবে ফিরে আসি আমরা।
লন্ডনে ফিরে
এক সপ্তাহ পরে এক সকালে ঘুম ভেঙে মনে হল আমার পায়ে কোনো সাড় নেই। অদ্ভুত অনুভূতি
তবে ভীতিপ্রদ নয়। ভাবলাম জুতো আঁটসাঁট হবার কারণে হয়েছে। অথবা হয়তো শোবার দোষে।
পরের দিন অসাড় অনুভূতিটা ওঠে হাঁটুতে; তার পরের দিন কোমরে। এবার উদ্বিগ্ন হই তবে
ভয় পাই না । হয়তো কোনো ভাইরাস সংক্রমণ হয়ে থাকবে প্রাচ্য সফরে। হয়তো মনোদৈহিক
প্রপঞ্চ। কোনো গুরুতর গন্ডগোল হয়েছে এমন ভাবনা প্রাণপণ ঠেকিয়ে রাখতে চাই । যথেষ্ট
সৃজনশীল হলে এধরনের প্রতিরোধকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন আপনি।
অসাড় ভাব বুকে উঠে দু’হাতে ছড়ালে চমকে উঠি অবিশ্বাসে। হাত জোড়া ঝনঝন করে যেন
কব্জিতে পক-তাগা (টুরনিকেট/ রক্ত বন্ধ করার ব্যান্ডেজ বিশেষ- অনুবাদক) বাঁধা
হয়েছে। ভয় পেলাম পরের দিন যখন হঠাৎ মনে হল মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস ‘র পূর্বলক্ষণ
দেখা দিয়েছে আমার।
আমার ডাক্তারের পেশাদার নিরাসক্তি দেখে বুঝি ব্যাপারটা খুব হাসিমস্করার হচ্ছে না।
শেষে বলেন –‘হ্যাঁ, মানে আমার আশঙ্কা ব্যাপারটা বেশ বড়ো কিছু‘।
‘কত বড়ো ? আমার কী হয়েছে?’
‘আমি জানি না’।
‘এটা কি এম.এস’?
‘আমি নিশ্চিত নই। এ রোগের জন্য আপনার বয়স একটু বেশি। চল্লিশের পর এ রোগ হবার ঘটনা
একরকম দুর্লভ’।
‘তবে কী এটা’ ?
‘অনেক কিছু হতে পারে। আমার মনে হয় আপনি একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। কপাল ভালো
হলে জন মর্গ্যান হিউজের সঙ্গে আপনাকে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি আমরা‘।
ফোন তুলে ক্যুইন স্কোয়ার লন্ডনের
ন্যাশানাল হসপিটাল ফর নার্ভাস ডিসিজেস-এর সঙ্গে কথা বলেন ডাক্তার। অ্যাডমিশন
রেজিট্রার সব শুনে একটি প্রশ্ন করেন যা আমাকে রিলে করা হয়।
আমার কি এখনও লিঙ্গোথ্থান হয় ?
‘উনি একজন অস্ট্রেলিয়ান’ –বিড়বিড় করেন
আমার ডাক্তার।
আমার মনে হল ডাক্তারের জবাব বিষয়টাকে নিয়মমাফিক সামাজিক অনুসন্ধান পর্যায়ে এনে দিল
কাজেই আমিও সে মেজাজ বজায় রেখেই উত্তর দিই। রেজিস্ট্রার জানালেন পরের দিন সকাল
ন’টায় হাজির থাকতে হবে আমাকে। জন মরগ্যান হিউজ আমাকে দেখবেন এবং আমার জন্য একটা
শয্যা তৈরি রাখা হবে।
(৮)
চলে আসার আগে
আমার ডাক্তার বললেন এসব চিকিৎসার সেরা জায়গা ন্যাশানাল। বিশ্ব স্নায়ুবিজ্ঞানের
পথপ্রদর্শক। দেখি ছোটো চকে শতাব্দী শেষের ভগ্নদশা একটা বাড়ি। পার্কিং সমস্যা আছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোয় ঢুকলেই সাধারণত যে ফ্লোর ওয়াক্সের গন্ধ পাওয়া যায় এখানেও সেই
পরিচিত গন্ধ। আমাকে যে লিফটের দিকে পাঠানো হল সেটা বিকল। ভিক্টোরীয় প্লাম্বিংয়ের
শিরা উপশিরা বেরিয়ে পড়া প্লাস্টারহীন সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা খুব বিরক্ত মুখ এক
নির্মাতার কাছে জানতে চাই কোনদিকে যাব। সে অন্যমনস্কভাবে বলে –‘জানি না বাপু’।
করিডোরে করিডোরে ঘুরে একটা বর্হিবিভাগীয় রোগী দপ্তরে এসে পড়লাম । সেখানে
হুইলচেয়ারে বসা ঝাঁকুনি মারা,কম্পমান রোগীদের ভিড়।
ওয়ার্ডে এক তরুণ নিউরোলজিস্ট খানিক দূর থেকে আমায় খুঁটিয়ে দেখে তারপর এগিয়ে এসে
জামাকাপড় খুলতে বলে। নিউরোলজিস্টদের কাছে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।
শারিরীক অক্ষমতার সুস্পষ্ট চিহ্ন ছাড়া আরও কি সুক্ষ সংকেত থাকে? যেমন রোগী কি
খিটখিটে, সন্দেহপ্রবণ,বিষণ্ণ অথবা কি অমনোযোগী ?এর সবকটা আমি এবং আমি ভীতও। তরুণ
নিউরোলজিস্ট আমার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে যায়। চিন্তান্বিত মুখে আমার অঙ্গে
তূলো বোলায়, সূচ দিয়ে হাল্কা আঁচড় কাটে। আমার পায়ে একটা হামিং টিউনিং ফর্ক (U
আকারের অ্যাকস্টিক রেজনেটর স্নায়ু চিকিৎসায় ব্যবহার হয় –অনুবাদক) ধরে বলে-‘ এটা কি
অনুভব করতে পারছেন’? তারপর সে আমায় বলে প্রথম ডিভিশন ফুটবলের চেয়ে কঠিন নিউরোলজি –
‘আমি হয়তো এটা ছেড়ে দিয়ে রক্তবিজ্ঞান বিষয় করব’। ডাক্তার নোট নিতে নিতে বলে -
‘হেমাটোলজি। আপনি জানেন? এই বিষয়টা তেমন অভিজাত নয়, প্রতিযোগিতাও কম।
হেমাটোলজিস্ট-রা তাদের বৌদের সময় দিতে পারে। ছেলেমেয়ের জন্মদিনও মনে রাখতে পারে’।
‘আমার কি হয়েছে’?
‘বিষয়টা যে মুহুর্তে আমরা ধরতে পারব একেবারে সরাসরি খবর হয়ে যাবে’- কথা দেয় ডাক্তার।
এক অল্পবয়সী আমেরিকান পরীক্ষা করে আমায়। সে এসেছে ডালাস, টেক্সাস থেকে। বলে
দুনিয়ার নিউরোলজিস্টদের মক্কা এটা। একটা তীক্ষ্ণ ধার দেওয়া পেন্সিল পেটের
চতুষ্কোণে বুলিয়ে বুলিয়ে রিফ্লেক্স পরীক্ষা করে। সেই ফাঁকে কথা বলে যায় –‘ এক ডজন
অথবা তারও বেশি দেশ থেকে বিশ্বাসীরা এখানে এসছে। আপনাকে পরের যে জন দেখবেন তিনি
তুরকি’।
‘আমার কি মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস হয়েছে’?
জানতে চাই।
সে বলে –‘ আরে মশাই শোনেন কোত্থেকে এসব ভাষা শিখেছেন’ ? পেন্সিলের ডগা চটপট পায়ের
তলায় বুলিয়ে নেয়। তুরকি অমায়িক কিন্তু সূচ ব্যবহারে কর্কশ। আমাকে এক পায়ে দাঁড়
করিয়ে নির্দিষ্ট আঙুল নাকে ছোঁয়াতে বলে। এরপর আমার বেডে বসে তুরকি ভাষায় নোট লিখে
নেয়।
‘আজ রাত অবধি বাঁচব তো’? জিজ্ঞাসা করি।
সে বলে হ্যাঁ, আল্লা চাইলে কোনো সমস্যা নেই। যে বইটা পড়ছিলাম সেটা লক্ষ্য করেছে
হংকংয়ের এক সুন্দরী নিউরোলজিস্ট। সে কিছুক্ষণ থেমে বইয়ের লেখক ব্রুস চ্যাটউইন-এর
লেখা সম্পর্কে তার নিজস্ব উপলব্ধির কথা বলে যায় । এরপর এক ডাচ নিউরোলজিস্ট আমাকে
হাত ভাঁজ করতে বলে –‘মনে হয় এখনও গ্লাস ধরতে পারেন আপনি ! নৈশভোজের পর স্কোয়ারের
অন্যদিকের পাবটায় যাবেন। দু পাঁইট সেরা তেঁতো স্বাদের বিয়ার। এটাই আপনার জন্য আমার
প্রেসক্রিপশন’। গুরুগম্ভীর এক ছোকরা ব্রিটিশ রেজিস্ট্রার সহৃদয়ভাবে আমায় পরীক্ষা
করে পরামর্শ দেয় , কিছু টেস্ট করতে বলে। কনসালটেন্ট তখন এসে পৌঁছেছেন। উদগ্রীব
জুনিয়ার নিউরোলজিস্টদের দলনেতা জন মর্গ্যান হিউজ। সুস্বাস্থ্য, সুন্দর পোশাক,
তীক্ষ্ণ চোখ,আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ছে চেহারায়। শুভ সন্ধ্যা জানিয়েই ছোটো হাতুড়ি দিয়ে
আমার দু’হাঁটুতে জোরে দুই ঘা দেন – ‘আপনার জেনারেল ফিজিশিয়ানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল’
–জন মর্গ্যান বলেন- ‘ উনি বলছিলেন আপনি নাকি সবে জিপে পশ্চিম চিন সফর করে
ফিরেছেন’।
‘ঠিকই শুনেছেন’
‘রাস্তা কেমন ছিল’ ?
‘ভয়ঙ্কর’
‘কতটা ভয়ঙ্কর’?
আমি সংক্ষেপে তাকে রাস্তার অবস্থার বিবরণ দিলাম। তিনি মাথা নাড়লেন।
‘এটা কি প্রাসঙ্গিক’ ?
আমি জিজ্ঞাসা করি
‘খুব সম্ভবত। তবে তার আগে আমাদের আরও কতগুলো সম্ভাবনা বাদ দিতে হবে’। তিনি হাসেন,
আমার হাত চাপড়ে পাশের বেডের রোগীর হাঁটু হাতুড়িপেটা করতে যান।
সে সন্ধেয় আমার ওয়ার্ডের সবাই মিলে পাব-এ যাওয়া হল। একে অন্যকে পানীয় কিনে দিয়ে
রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করি আমরা । বাদামি চামড়া ফিট চেহারার এক
অল্পবয়সী স্টকব্রোকার খুব নিরুত্তাপ গলায় বলে দু’দিন বাদে তার ব্রেন টিউমার
অপারেশন হবে। মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস-এর দুই রোগী সদ্য বেরনো হুইলচেয়ার সম্পর্কে খুব
উদ্দীপিত আলোচনা করছিল। সেটা নাকি এত পোক্ত যে তিনজনকে নিয়ে পাহাড় বেয়ে তির-গতিতে
নামতে পারে। এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ বলে তার মতে ন্যাশানাল-এর ঘৃণ্যতম বস্তু সূচগুলো।
‘আমার রাতের দুঃস্বপ্ন ওগুলো। তোমার মাইলোগ্রাম (শিরদাঁড়ার ইনভেসিভ ডায়াগ্নস্টিক
টেস্ট- অনুবাদক ) হয়েছে এর মধ্যে ? শিরদাঁড়ায় ? ভাই এরা তোমার শরীরে পেরেক পুঁতে
দেবে’। পাব বন্ধ হবার সময় হলে ওয়ার্ডে ফিরে আসি সবাই । শুতে যাবার আগে আমাদের কোকো
খেতে দেয় দুই সজ্জন ফিলিপিনো নাইট নার্স।
টেস্ট শুরু পরের সকালে। ছাড়াছাড়াভাবে দশ দিন চলে। সূচের সাইজ বদলায়। নানারকম। আমার
দু’হাতে লাগানো ইলেকট্রড থেকে মাইলোগ্রাম-এর শঙ্কু আকারের মোটা সূচ। তৃতীয় ও
চতুর্থ লাম্বার ভার্টিব্রা-য় ওই মোটা সূচ যখন ঢোকাচ্ছে রেডিওলজিস্ট আমি দাঁতে দাঁত
পিষে তাকে বলি পিঠে ছুরি মারলে কেমন লাগে তা আমার জানা। ‘ ও তাই ‘? সে বলে।
সহকারীর সঙ্গে ইয়র্কশায়ার যাবার ট্রেনের সময় নিয়ে তর্ক করতে করতে জিন-এর মতো
স্বচ্ছ রং সেরিব্রোস্পাইনাল তরল সিরিঞ্জ ভরতি বার করে তার বদলে রেডিওপেক কনট্রাস্ট
পদার্থ শিরদাঁড়ায় চালিয়ে কীভাবে সেটা চুঁইয়ে যাচ্ছে এক্সরে তে দেখে।
(৯)
এক সপ্তাহ
পাগল পাগল লাগে মাইলোগ্রাম’র যন্ত্রণায়। সেই সময়টুকুর বেশিরভাগ কাটে বিভিন্ন
স্ক্যানারে বন্দীদশায়। দমবন্ধ করা জরায়ুর মতো যন্ত্রগুলো ক্লিক ও গুনগুন আওয়াজে
ঘুরে আমার ঘাড়ের গভীরে ছানবিন করে। পারমাণবিক ম্যাগনেটিক ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার
করা দুই মিলিয়ন পাউণ্ডের এক দৈত্য এত নিঁখুত যে একটা গিলে ফেলা পয়সার ছবি বার করে
আনবে অথবা ডাক্তার চাইলে রানিমা’র ডান কানে ঝুলে থাকা দুল বড়ো করে দেখাবে।
ফলাফল যাকিছু পাওয়া গেল সেসব পড়ে মূল্যায়ন করলেন এই বিদ্যার সেরা চিন্তাশীলরা ।
খুব যত্ন নিয়ে কাজ করলেন তাঁরা । বাদ দিলেন সেগুলো নিশ্চিতভাবেই যেগুলো আমার ছিল
না। মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস তার মধ্যে একটা । ক্রমশ তাঁদের আগ্রহ বাড়ল আমার
শিরদাঁড়ার ঠিক উপরে একটা দুর্লভ জন্মগত ত্রুটি নিয়ে । তাঁরা এর নাম দেন আর্নল্ড-
চিয়ারি বিকলাঙ্গতা। তাঁদের ধারণা হয় কাশগড় যাবার রাস্তার সঙ্গে এর হয়তো সত্যিই
সম্পর্ক আছে। পরে অবশ্য অনুসন্ধানের সে রাস্তা বাতিল করলেন তাঁরা। একটা স্ক্যানে
ছোটো টিউমার ধরা পড়ে মেরুদন্ডে। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের ভয়াল সম্ভাবনার মুখোমুখি
দাঁড়াই। প্রার্থনা করি বহুদিন। দুশ্চিন্তা হয় বীমা পলিসিগুলো সম্পর্কে। ভিজিটিং
আওয়ারে আমার দুশ্চিন্তার ছায়া দেখি আমার পরিবারের চোখে। বহু বছর বাদে স্বপ্নে ফিরে
আসে চেরাপুঞ্জীর ছবিটা। আরও গভীর স্ক্যানের পর বোঝা গেলে ছায়ার সঙ্গে ঘুঁষোঘুঁষি
করছিলাম আমরা। এক রৌদ্রজ্জ্বল সকালে গুরুগম্ভীর অল্পবয়সী রেজিস্ট্রার আকর্ণবিস্তৃত
হেসে আমাকে জানায় টিউমারটা গলে গেছে।
‘কী বলছেন আপনি’ ? আমি জিজ্ঞাসা করি।
‘ওটা চোখের ভ্রম ছিল। স্ক্যানের উপর পড়া ছায়া’।
সাদা কোট পরা পার্ষদদের নিয়ে শেষবারের মতো তাঁর রায় শোনাতে এলেন জন মরগ্যান-হিউজ।
বলেন চিনা জিপের মারাত্মক ঝাঁকুনিতে আর্নল্ড-চিয়ারি জনিত ক্ষতি আরও বেড়েছে।
লঘুমস্তিষ্কের এক নির্ভরশীল গ্রন্থি শিরদাঁড়ার উপরিভাগ স্পর্শ করায় অসাড় অনুভূতি
এবং ঝনঝনানি হচ্ছে। এগুলো নিজে থেকে সারতে পারে আবার নাও সারতে পারে। এর কোনো
চিকিৎসা জানা যায়নি। একটা বিশাল বেঢপ অর্থোপেডিক কলার ধরিয়ে দিয়ে আমাকে বলা হল
যেকোনো ধরনের যানবাহনে যেতে আসতে সেটি ব্যবহার করতে হবে। অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে
জিপ ও খানাখন্দভরা রাস্তা। ফের এধরনের তীব্র চোট পেলে সারা জীবন হুইলচেয়ারে কাটাতে
হবে আমাকে। বড়োসড়ো পড়ে যাওয়াতেও একইরকম কুফল হবে। সবশেষে তাঁর সহকর্মী,
পরামর্শকারী স্নায়ুশল্যবিদ ডেভিড গ্রান্ট-কে আমার ব্যাপারটা দেখতে বললেন জন মরগ্যান-হিউজ।
শল্যচিকিৎসায় কাজ হতে পারে তবে সেটা একমাত্র বলবেন ডঃ গ্রান্ট।
অপারেশন থিয়েটারে দীর্ঘ দিন কাটিয়ে এক সন্ধেয় এলেন ডেভিড গ্রান্ট। এসে নার্সদের
কুঠরিতে ঢুকে এক ঘন্টা নিশ্চল বসে থাকেন। ঘসা কাচের ভিতর দিয়ে তাঁর ছায়াচিত্র দেখা
যাচ্ছিল। নিবিষ্টভাবে দেখছিলেন আমার মেডিকেল ফাইল। অবশেষে বেরিয়ে আসেন। তাঁর
ছিপছিপে চেহারা। নিরুদ্বেগ দৃষ্টি। বলেন অপারেশনের সুপারিশ তিনি করছেন না।
সাফল্যের সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। আর তাতেও চিরতরে ভালো হবার গ্যারান্টি নেই।
তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার ন্যাশানাল হেলথ ওয়ার্ডের সকলকে বিদায় জানালাম। ভাবলাম
এক পাউন্ডেরও কম খরচে সেরা স্নায়ু-চিকিৎসা পেয়েছি। ওই দামে অনেক চকোলেট বার দেবে
হাসপাতালের বহির্বিভাগের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র।
কিছুদিন বাদে অবসাদ চেপে ধরে । শার্টের বোতাম লাগাতে,জুতোর ফিতে বাঁধতে দরকার হয়
দীর্ঘ ক্ষিপ্ত মুহুর্ত। রীতিমতো কসরত,মনঃসংযোগ করতে হয় এসব তুচ্ছ কাজে। মাঝে মাঝে
স্ত্রীর সাহায্য লাগে। বাইরের জগতে ছড়ায় সমস্যাটা। অপদস্থ যাতে কম হই তার জন্য
কিছু বাস্তব উপায় উদ্ভাবন করেও (এক খবরের কাগজ বিক্রেতা আমায় বেতো আঙুলে পয়সা
হাতড়াতে দেখছিল চোখ পাকিয়ে। তারপর থেকে আমি পয়সা হাতে তৈরি রাখি ) নিজেকে কেমন
জবুথবু, বোকা লাগে। কেমন আমূল পরিবর্তন আসছিল। হতোদ্যম হয়ে যাই । কাজ করা মুস্কিল
হয়। হাত ভাঁজ করলে অসাড় ভাবটা কয়েক সেকেন্ড কাটলেও বোধহয় তা মনেও চুঁইয়ে পড়ছিল।
একসময় এই ঘর আরামদায়ক ছিল। খুব বড়ো কিছু না হলেও প্রিয় চেনা জিনিসে সাজানো। এখন
এটা একটা গুহা, শীতল,অন্ধকার, বাসের প্রায় অযোগ্য। আমার মনোযোগ কমে যায়। প্রচুর
মদ্যপান করতে থাকি। এক রাতের পার্টিতে আমার ডাক্তারের সঙ্গে দেখা। আমার দিকে এগিয়ে
এসে বলে-‘এটা তোমার তিন নম্বর পেগ ‘
‘বাজি ধর’ আমি বলি
‘ এটা ওষুধ নয় অ্যালেক্স।
স্বল্পকালীন উপকার হয়ত কিছু হল কিন্তু এটা তোমার
স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে।
‘ঠিক আছে’ আমি বলি। হুইস্কি নামিয়ে রেখে অরেঞ্জ জুস তুলে নিই । তুমি ইঞ্জিনে বালি
ঢালছো’। ডাক্তার চলে যেতে বেশ কয়েক আউন্স ভদকা ঢালি তাতে। ঘুরতে থাকি চারপাশ। আমার
ইঞ্জিন তখন পুরোদমে চলছে। ডাক্তার ! আমার জীবনের সত্যনাশ করেছে এরা !
বাস্তব ফেরে পরের সকালে যখন দমকা বাতাস হেমন্তের প্রথম পাতা ঝরায়। ন্যাশানাল
কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কড়া সতর্কতা জারি করে। বৃষ্টির জলে পিছল হয়ে যাওয়া পাতা পতনের
একটা বড়ো কারণ। তুষারপাতের চেয়েও তা বিপজ্জনক যেহেতু পথচারীদের এ বিষয়ে কোনো হুঁশ
থাকে না। এখন জমির উপর দিয়ে হাঁটতেও দুশ্চিন্তা হয়। বুড়ো মানুষের নড়বড়ে চলার ধাঁচে
সতর্কভাবে এক পৃথিবীর মাঝ দিয়ে হাঁটি যেখানে মাটিতে বিস্ফোরক পাতা। গাড়িতে,বাসে,
ট্রেনে অর্থোপেডিক কলার ব্যবহার করি। নীচের ঠোঁট থেকে কন্ঠা অবধি ছড়ানো
ফোমপ্লাস্টিকের বর্মটা পড়লে আমাকে পুতুলনাচের কোলাব্যাঙের মতো দেখায়। স্কুলের ছোটো
বাচ্চাগুলো খিলখিলিয়ে হাসে,বয়স্করা হাঁ করে দেখে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলে বিব্রত
হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। একদিন এক বয়স্কা মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে তার জায়গা ছেড়ে
দিলেন। বাড়ি ফিরে আলমারির পিছনে ছুঁড়ে ফেলে দিই কলারটাকে। ওটা না পড়লে যে শারিরীক
ক্ষতির আশঙ্কা তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় ওটা পড়ে যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল
আমার আত্মসম্মান।
(১০)
ছাড়া পাবার
অনেক মাস বাদে রুটিন অন্তিম চেকআপের জন্য আমায় ডেকে পাঠায় ন্যাশানাল হসপিটাল।
মার্চের অন্ধকার বিকেল। বর্হিবিভাগের প্রতীক্ষালয়ে অসুস্থ,অবসন্ন মানুষ ও তাদের
বিষণ্ণ-মুখ আত্মীয়দের জটলা। এক মহিলা এলেন। আমার পাশের সিটটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেন
সেটা খালি আছে কিনা। দারচিনি রং মসৃণ গায়ের চামড়া। মুখাবয়ব চোখে পড়ার মতো। চওড়া
কপাল, চিবুকের হাড় যেন খোদাই করা। উজ্জ্বল সবুজ চোখ। পোশাকও তার নজর কাড়া। ঘোড়া
চড়ার চওড়া কানা স্প্যানিশ টুপি, চকচকে বুট হাঁটু অবধি আর খুবই ছোটো সোনালি রেশমি
স্কার্ট। মহিলার পাজোড়া খুব সুন্দর।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে এমন এক অপ্রত্যাশিত
ভঙ্গিমা করেন যেটা গোটা ঘরটাকেই ইঙ্গিত করে –‘ঈশ্বর’! তিনি বলেন।
‘মজার জায়গা নয়’ –আমি সায় দিই।
‘আপনি কার জন্য অপেক্ষা করছেন’?
‘কেউ না। আমি একজন রোগী’
‘ ও তাই’? তার সুন্দর চোখ জোড়া আমার দিকে ঘুরে যায়। তিনি ঈষৎ ক্ষীণদৃষ্টি। ‘আপনাকে
দেখে তো খুব অসুস্থ মনে হয় না’।
কন্ঠস্বর একেবারে খাঁটি অভিজাত ইংরেজ কিন্তু উনি ইংরেজ মহিলা নন। ইংরেজ মহিলারা
কখনওই এত সরাসরি কথা বলবে না। আমি সংক্ষেপে আমার অবস্থার কথা বলি তিনি খুব নিবিষ্ট
হয়ে শোনেন। তারপর চামড়ার চওড়া হাতব্যাগ খুলে এক প্যাকেট ছোটো স্যুইস চুরুট বার
করেন।
‘আমরা ধূমপান করতে পারি ‘?
ঘরের অর্ধেক মানুষ ধূমপান করছে। মহিলা
আমাকে একটা চুরুট দিয়ে নিজেরটা ধরান জিপো লাইটারে। চুরুটে লিকরিস (একধরনের উদ্ভিদ
যার শিকড় মিষ্টি সুগন্ধি -অনুবাদক ) –এর হাল্কা গন্ধ পাই।
মহিলা বলেন – ‘আমার স্বামী এখানে এসেছেন জানেন। উনিও আপনার মতো একজন রোগী।
উনি এক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করছেন। আমার
সঙ্গে ওঁর তিনটেয় দেখা হবার কথা। হয়তো খেয়াল রাখবে অথবা নাও রাখতে পারে’।
‘ওঁর কি হয়েছে’?
‘মাইগ্রেন। প্রতি তিন বছর ওর এটা হয় প্রায় কাঁটায় কাঁটায়। এটাকে বলে ‘ক্লাস্টার
এফেক্ট’। যখন এরকম অবস্থার মাঝখান দিয়ে যায় তখন ও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। যাকে বলে বদ্ধ
উন্মাদ। এখন হয়তো ভিতরে ঢুকে কমিক গান শোনাচ্ছে ডাক্তারকে। আমি হাসি এবং মনে হল
সামান্য হলেও নড়েচড়ে উঠেছে আমার পাথর হয়ে যাওয়া অনুভূতি ।
মহিলা বলেন
তার স্বামীর নাম অ্যালয়সিস এবং কোনো কোনো মহল তাকে ধনী ও অপদার্থ বলে। প্রকাশনার
ব্যবসা আছে কিন্তু নিজেকে গ্লাইডার পাইলট বলে পরিচয় দেয়। বম্বেতে ওদের বাড়ির
লাগোয়া একটা ছোটো এয়ারস্ট্রিপ আছে। তার আকাশে চক্কর মেরে বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছে
অ্যালয়সিস। একসময় সর্বভারতীয় উড়ান রেকর্ড ছিল তার। পশ্চিমঘাটের উপর হঠকারী
পরিস্থিতিতে এই রেকর্ড সে হাসিল করে। ঝোড়ো মৌসুমী বাতাস এতটাই উঁচুতে তুলে দিয়েছিল
তার গ্লাইডার যে তাকে আর দেখা যাচ্ছিল না। মহিলা ধরে নিয়েছিলেন যে তার স্বামীকে
বার্মা উড়িয়ে নিয়ে গেছে হাওয়া।
আমার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণদৃষ্টি সংক্ষিপ্ত হাসিটি হাসেন মহিলা। তারপর আমার কোট
শ্যেনচোখে দেখে ঝুঁকে পড়ে কলার থেকে একটা চুল তুলে নেন। ‘মাফ করবেন’–বিড়বিড় করেন
তিনি।
‘জানতাম না আপনাদের বর্ষায় বাতাস বয়’ আমি বলি।
‘অবশ্যই। বাতাস বৃষ্টি নিয়ে আসে। আপনি কখনও মৌসুমি বাতাসের বিস্ফোট দেখেননি ?
বম্বেতে এটা একটা ঘটনা। মাসের পর মাস গরমে একেবারে আইঢাই শহরটা। তারপর সাধারণত ১০
জুনের বিকেলে বিশাল মেঘ জমতে থাকে সমুদ্রের উপর। যার কথা আপনি বলছেন সেই বাতাস এসে
পড়ে খুব তড়িঘড়ি। আশ্রয় না নেওয়া যেকোনো ছোটো নৌকা ডুবিয়ে দেবে এত তার শক্তি। বাতাস
পড়ে যায়। খুব অন্ধকার ঘনিয়ে আসে । ভীষণ বাজ পড়ে ,বিদ্যুৎ চমকায়। প্লাবন নেমে আসে
তারপর। হঠাৎ শীতল হয় বাতাস। ভরে ওঠে ফুলের সুগন্ধে। এটা আনন্দের সময়। নতুন হয়ে
ওঠার সময়’। উনি ভুরু কুঁচকে তাকান আমার দিকে ‘ আর এই সময় সম্ভবত নিজেকে খাঁটি
ভারতীয় মনে হয় আমার’।
শুনতে শুনতে
মনে পড়ছিল আমাদের দ্বীপের বৃষ্টির স্মৃতি। তাদের কথা ভাবিনি বহুবছর । আবার তারা
ফিরে এল । তুমুলভাবে ঝরতে লাগল আমার মাথার ভিতর। লেন্সে তোলা ছবির মতো স্পষ্ট
দৃশ্য। আমাদের বারান্দার কাঠের পাটাতনগুলোর মাঝের সব ফাটল, সিলিংয়ের মাকড়সা জাল।
শিক ভাঙা পুরোনো ছাতা মাথায় ক্লান্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে বাবা। নরম ছড়ানো আলো।
ক্ষণিক অনুভব করি সেই আশ্চর্য করুণাঘন মুহুর্তগুলো বৃষ্টি যা বারবার বয়ে এনেছে,
যেভাবে আমার পাপ ধুয়েছে ধারাবর্ষণ –আক্ষরিক অর্থে যদিও নয় কারণ সাধারণত আমি ঘরে
থাকাই পছন্দ করতাম এবং ঘরবন্দী অবস্থাতেই প্রলয়ঙ্কর কুকর্মগুলো সেরে ফেলতাম। যেমন
মনেমনে হৃষ্ট গোলাইটলি (ইংরেজি সারনেম/ পদবি অনুবাদক) বোনদের চার্চের ভিতর নগ্ন
করতাম খুব সহজেই। ওদের অর্ধোন্মাদ বাবা পার্সিফাল নামের দুই পালতোলা জাহাজ চালাত।
সেই একই
স্বস্তি ও শান্তি কিছুটা যেন ফিরে পাচ্ছিলাম। মহিলাকে বলি ওরকম বৃষ্টিতে আমারও
ছেলেবেলা কেটেছে। চেরাপুঞ্জীর পুরোনো ছবিটা মনে পড়ল। জিজ্ঞাসা করি তিনি কি গেছেন
চেরাপুঞ্জী। তিনি তার ঈষৎ ব্যহতদৃষ্টিতে আবার গভীরভাবে দেখেন আমায়। মেঘালয়ের
জায়গাটা কি? এখন সেখানে কেউ যায় না। বিপজ্জনক জায়গা। তুমুল গণ-বিক্ষোভ চলছে ওখানে।
তবে সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন ওখানে গিয়েছিলেন মহিলার বাবা। তাকে অদ্ভুত আচ্ছন্ন
করেছে জায়গাটা । উনি বলতেন অপার্থিব। তির ধনুকধারী উলঙ্গ শিকারিরা থাকে সেখানকার
জঙ্গলে। একবার কুয়াশার মাঝে হাঁটতে হাঁটতে ভদ্রলোক একটা পুরোনো ব্রিটিশ কবরস্থান
দেখতে পান। সবাই নাকি আত্মঘাতী হয়েছিল লেখা স্মৃতিফলকগুলোয়। মহিলা একটু কেঁপে উঠে
আমার হাত ছুঁয়ে ফেলেন। ‘বৃষ্টি নামলে আপনার দ্বীপে পার্টি হত’?
‘পার্টি? নাঃ, ওই কেতাটা আমাদের ছিল না’। আমি ওয়াপশটের কথা ভাবছিলাম।
‘আমরা করতাম। আমরা এখনও করি গোয়াতে। একধরনের পারিবারিক পুনর্মিলন। মৌসুমী
বিস্ফোটের কিছুদিন বাদে সবাই চমৎকার সিক্ত গোয়ায় ছোটে বৃষ্টিতে ভিজতে। আমার কাছে
এটা বছরের সেরা সময়’।
[ক্রমশ ]