পীর পুকুরের মেলা
-অবিন সেন
সে প্রায় পাঁচশ বছর আগের কথা। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে সমস্ত পীর,
সুফী, গাজী ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন
ছিলেন উদয়নারায়নপুরের সিংটি গ্রামের ভাই খাঁ পীর। ‘পীর’ শব্দটা ফারসি, তার অর্থ
ইসলামী ধারায় আধ্যাত্মিক গুরু, মুসলমান সাধক ও মহাত্মা ব্যক্তি, আত্মজ্ঞানী। তবে
ভাই খাঁ পীরের আসল নাম বা পরিচয় কী তা জানা যায়নি। আসলে তাঁকে নিয়ে নানা কিংবদন্তী
কাহিনী প্রচলিত আছে। তার কিছু বিশ্বাসযোগ্য আবার কিছু কাহিনীকে যুক্তি তর্কের আলোয়
ব্যাখ্যা করা কঠিন। ফলে, সেই সমস্ত কিংবদন্তির আড়ালে তাঁর আসল পরিচয় চাপা পড়ে
গিয়েছে। প্রচলিত আছে, তাঁর খেলার সঙ্গী সাথীরা তাঁকে ‘ভাই’ বলে ডাকত। সেই ডাক
থেকেই তাঁর নাম ভাই খাঁ বলে পরিচিত হয়ে গিয়েছে।
সিংটি গ্রামের পশ্চিম সীমানায় ফাঁকা মাঠে রাখাল বালকেরা ভাই
খাঁর খেলার সাথী ছিল। বলা যায় তিনি ছিলেন তাঁদের সর্দার। কেউ কোনও বিপদে পড়লে তিনি
ভরসা দিতেন। কিংবা ঝড় বৃষ্টির মতো কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে থাকতেন অবিচলিত। শান্ত
মায়া-ভারা চোখে বুক চিতিয়ে তিনি সঙ্গী সাথীদের ভরসা দিতেন। এমন কী এও শোনা যায়,
তাঁর অবিচলিত শান্ত চাহনি আর মধুর ভরসার বাক্য শুনে অসুস্থের অসুখ পর্যন্ত সেরে
যেত। এর ফলে ধীরে ধীরে ভাই খাঁর নামযশ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। লক্ষ করার বিষয় এই
কাহিনীর সঙ্গে বালক শ্রীকৃষ্ণের কাহিনীর বড় মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
আরও একটা কাহিনী প্রচারিত আছে, সিংটি বাজারে কোনও এক মিষ্টির
দোকানে ভাই খাঁ কর্মচারীর কাজ করতেন। সেই সময়ে এই অঞ্চলটি ভূরীশ্রষ্ঠী রাজ্যের
অধীন ছিল। ভূরীশ্রেষ্ঠী রাজ্যের পতনের পরে বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দ্র এই
রাজ্য অধিকার করে নেন। এই অঞ্চলের মধ্যদিয়ে বয়ে গেছে বাংলার দুঃখ দামোদর নদ।
ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য এই অঞ্চলের সঙ্গে তৎকালীন বাংলার প্রসিদ্ধ তাম্রলিপ্ত
বন্দরের জলপথে যোগাযোগ ছিল। একদা বর্ধমান মহারাজের একটি বাণিজ্য সামগ্রী বোঝাই
নৌকা নদীর চড়ায় আটকে যায়। শত চেষ্টাতেও সেই নৌকাকে আর নড়ানো যায় না। এই সংবাদ
পৌঁছল বর্ধমান মহারাজের কানে। তাঁর আদেশে লোক লস্কর সৈন্য সামন্ত এলো। কিন্তু
সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়, নৌকা আর নড়ে না। মহারাজের এই বিপদের কথা শুনে ভাই খাঁ
তাঁর সঙ্গী সাথীদের সঙ্গে নিয়ে জলে কাদায় নেমে নৌকা ঠেলতে লাগলেন। সকলে অবাক হয়ে
দেখল পাহাড়ের মতো অনড় নৌকা নড়তে শুরু করেছে। নৌকা আবার জলে ভাসল। ভাই খাঁর এই
অলৌকিক ক্ষমতার দেখে উপস্থিত লোক-লস্কর, সৈন্য সামন্ত হর্ষ ধ্বনি দিয়ে উঠল। কিন্তু
এই কথা কিছুতেই বিশ্বাস করেনা, ভাই খাঁর দোকানের মালিক। বরং জল কাদা মাখা মলিন ভাই
খাঁকে দেখে সে তিরস্কার করে।
বর্ধমান মহারাজের কানে এই অলৌকিক সংবাদ পৌঁছালে তিনি প্রভূত
আনন্দিত হয়ে ফল মিষ্টি নিয়ে মহাসমারোহে পীরের দরগায় নিবেদন করতে আসেন। কিন্তু কয়েক
জন খল ব্রাহ্মণের প্ররোচনায় স্থানীয় কিছু হিন্দু এই কাজে বাধা দেয়, কারণ মুসলমানের
ছোঁয়ায় হিন্দুদের জাত যাবে। সংহতি মনোভাবাপন্ন ভাই খাঁ হিন্দু-মুসলমানের এই বিভেদ
সৃষ্টিকারী পরিস্থিতিকে শান্ত কারার জন্য মহারাজকে একটি বাতাসা দিয়ে মানত রক্ষা
করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু সিংটি বাজারে কোনও দোকানেই বাতাসা পাওয়া যায় না।
তখন ভাই খাঁ তাঁর দোকানদারের কাছে স্বপ্নাদেশে খবর পাঠান, দোকানের কোনে যে কালো
হাঁড়ি আছে তাতে অনেক বাতাসা আছে। সত্যি তাই। অথচ দোকানদার স্থির জানেন দোকানে এমন
কোনও হাঁড়িই ছিল না। তিনি এবার ভাই খাঁর অলৌকিক ক্ষমতার কথা যেন বিশ্বাস করতে
পারলেন। মহারাজাও ভাই খাঁর এই ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হলেন। মুগ্ধ মহারাজা ভাই খাঁর
জন্য একশ পঁয়ষট্টি বিঘা নিষ্কর জমি দান করলেন।পীরের মাজারের জন্য দান করলেন আরও এক
একর ছাপ্পান্ন শতক জমি।
এ হেন অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন ভাই খাঁর কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে
পড়তে লাগল। এক অবাঙালী মাড়োয়াড়ি ভাই খাঁর দ্বারা কঠিন ব্যাধি থেকে মুক্ত হয়ে ছাদ
যুক্ত পাকা পীরের মাজার তৈরি করার কথা বলেন। কিন্তু ভাই খাঁর ছাদ তৈরিতে নিষেধ
ছিল। ফলে এই নিষেধ অমান্য করে ছাদ নির্মাণ হলে মাজারের ছাদ নিজের থেকেই ভেঙে পড়ে।
মাজারের পাশে আছে পুকুর। ভাই খাঁ নিজের হাতে সেই পুকুরের
সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। বহু মানুষ হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে এই পুকুরে
তাঁদের মনস্কামনা পূরণের জন্য মানত করতে আসেন। আজো।
কথিত কাছে, ভাই খাঁ মৃত্যুর কয়েকদিন আগে স্বপ্নাদেশে দূর
দূরান্তে তাঁর শিষ্যদের কাছে নিজের মৃত্যু সংবাদ পৌঁছে দেন। শিষ্যরা ছুটে এলে পৌষ
সংক্রান্তির দিন রাত্রে মেলা প্রচলনের আদেশ দিয়ে তিনি ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেন।
হাওড়া জেলায় পাঁচশ বছরের পুরানো, প্রতি বছর পয়লা মাঘ এক দিনের
এই মেলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক আশ্চর্য উদাহরণ। সারাদিন ব্যাপী অবিশ্রান্ত
জনস্রোতে এই মেলা প্রাঙ্গণ যেন মিলনের ঐকতানে মুখরিত হয়ে ওঠে। এই মেলা প্রান্তিক
শ্রমজীবী কৃষিজীবী মানুষের মেলা। সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে হিন্দু মুসলমানকে বুকে টেনে
নেয়, মুসলমান হিন্দুকে পাশে বসিয়ে সুখ দুঃখের গল্প শোনায়। তারা কথা বলে ভালোবাসার,
সম্প্রীতির, সংহতির।
“তুমি আমার বটের ঝুরিতে সুতো বাঁধো
আমি তোমার পীরের দরগায় চেরাগ জ্বালি”।